২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, সোমবার, ২:৩৭

প্রযুক্তিতে বাংলার বিশ্বায়ন

অনিয়ম-অবহেলার চক্করে চার বছর

হাত লাগাতে হবে না, কথা বলে টাইপ করা যাবে। লিখিত পাঠ কম্পিউটার পড়ে শোনাবে। মুদ্রিত বই-দলিল দ্রুত সফটকপিতে রূপান্তরিত হবে। অন্য ভাষায় বাংলা শব্দ বা পাঠের সঠিক যান্ত্রিক অনুবাদ পাওয়া যাবে। সার্চ ইঞ্জিনে বাংলায় কোনো বিষয় খুঁজতে কণ্ঠস্বর ব্যবহার করা যাবে। বাংলা ভাষার বিশাল মৌখিক ও লিখিত নমুনা (করপাস) গড়ে উঠবে। এমন অনেক স্বপ্নের কথা শুনিয়ে ১৫৮ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও তা স্বপ্নই রয়ে গেছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে নেওয়া প্রকল্পে গাফিলতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প গ্রহণের পর এক দফা সময় বাড়লেও বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাজনক। আরেক দফা সময় বাড়ানোর আবেদন করা হচ্ছে। তাই ২০২৩ সালের আগে আলোর মুখ দেখছে না ১৬টি ডিজিটাল টুল, সফটওয়্যার ও রিসোর্স।

ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষার বিশ্বায়নে এমন দীর্ঘসূত্রতা মেনে নেওয়া যায় না বলে মন্তব্য এসেছে উচ্চ পর্যায় থেকে।

তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল দুনিয়ায় ভাষার বিশ্বায়ন হচ্ছে। যেসব ভাষা প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না সেগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।

তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও ব্যবহারযোগ্যতা বাড়াতে ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ নামের প্রকল্পটি শুরু হয়। পরে ২০১৭ সালে প্রথম দফার সংশোধন অনুমোদন করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। তবে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি তখন। পরে আবার সংশোধন করে দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্পটি চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। কিন্তু প্রকল্পের বাস্তবায়ন সন্তোষজনক না হওয়ায় আরেক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করার আবেদন করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার একটি প্রধান শর্ত বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তিবান্ধব করা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ হলে দেশের প্রশাসনিকব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও যোগাযোগ কাঠামোতে নতুন পরিবর্তন সূচিত হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা ভাষার যথাযথ মর্যাদা লাভ করা ও উৎকর্ষে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিসরে নেতৃস্থানীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

প্রকল্পটির উদ্দেশ্য, বাংলা ভাষার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে (ওয়েব, মোবাইল, কম্পিউটার) ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন সফটওয়্যার, টুল ও রিসোর্স উন্নয়ন করা, যাতে বাংলা ভাষা কম্পিউটারে ব্যবহার করতে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে। এই প্রকল্পের আওতায় বাংলা ভাষার জন্য ১৬টি সফটওয়্যার, টুল ও রিসোর্স উন্নয়ন করার কথা ছিল। এটি বাস্তবায়ন করা হলে ব্যবহারকারীরা বিনা মূল্যে ৪০টি সুবিধা পেত। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, করপোরেট খাত, গণমাধ্যম, গবেষক, আইওটি এবং রোবটিক্স উপকৃত হতো।

কম্পিউটার বা স্মার্টফোন নয় কিন্তু ইন্টারনেটে যুক্ত, সাধারণভাবে এমন যন্ত্র ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) পণ্য হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে রোবটিক্স হলো প্রযুক্তির একটি শাখা, যেটি রোবট ডিজাইন, নির্মাণ, কার্যক্রম ও প্রয়োগ নিয়ে কাজ করে।

এই প্রকল্পের অধীন প্রধান উপাদানগুলো হচ্ছে—বাংলা করপাস উন্নয়ন, বাংলা থেকে পৃথিবীর প্রধান ১০টি ভাষায় স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক অনুবাদক উন্নয়ন, বাংলা টাইপ করা ও হাতের লেখা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্তকরণ ও কম্পোজ, কথা থেকে লেখা এবং লেখা থেকে কথায় রূপান্তর, জাতীয় বাংলা কি-বোর্ডের উন্নয়ন, বাংলা ফন্ট রূপান্তর ইঞ্জিন, বাংলা বানান ও ব্যাকরণ সংশোধক উন্নয়ন, স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার উন্নয়ন, বাংলা অনুভূতি বিশ্লেষণের সফটওয়্যার উন্নয়ন, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষার জন্য কি-বোর্ড উন্নয়ন।

এ প্রকল্পটি শুরুর আগেই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টিম ইঞ্জিনের কাছ থেকে বাংলা অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন বা ওসিআর কেনা হয়েছিল। তারা এই সফটওয়্যারটি উদ্বোধন করে ২০১৪ সালে। কিন্তু সোর্সকোড না থাকায় তা ব্যবহার করা যায়নি।

প্রকল্পটির প্রথম দিকে ডাক, টেলি যোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন মোস্তাফা জব্বার। পরে তথ্য-প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ আলাদা করা হয়।

প্রকল্পটি শুরুর সময় মোস্তাফা জব্বার কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, ‘এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য কম্পিউটিং জগতে বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্প্রসারণে কাজ শুরু করা। প্রাণের বাংলা ভাষা নিয়ে কোনো অবহেলা করতে দেব না।’

প্রকল্পটির সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মোস্তাফা জব্বার গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০১৯ সালের মে মাস থেকে আইসিটি বিভাগ আমার অধীনে নেই। এমনকি আমি যে বিশেষজ্ঞ কমিটিতে ছিলাম সেখানেও বর্তমানে নেই। এ কারণে এর সর্বশেষ অবস্থা আমার জানা নেই। আমি যখন ২০১৮ সালে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিই, তখন প্রকল্পটিতে কেবল পিডি (প্রকল্প পরিচালক) নিয়োগ করার পর প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছিল। বুয়েটকে (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) এই প্রকল্পের স্পেসিফিকেশন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমি এটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।’

মন্ত্রী বলেন, টিম ইঞ্জিন নামে একটি কম্পানি ‘পুঁথি’ নামের একটি ওসিআর তৈরি করেছিল। পরবর্তীকালে আইসিটি বিভাগ কিনে নিয়ে সেটিকে ব্যবহারযোগ্য ঘোষণা করেছিল। কিন্তু তারা টিম ইঞ্জিন সফটওয়্যারের সোর্সকোর্ড দেয়নি। যার ফলে ওসিআরকে আবার শূন্য থেকে শুরু করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পরে রিভ সিস্টেমকে ওসিআর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাদের ওসিআর আইসিটি বিভাগের সফটওয়্যার কোয়ালিটি ল্যাবে দিয়ে দেখা গেল এটা পুরোটাই পাইরেসি করা। অর্থাৎ অন্যদের সোর্সকোড নিয়ে এটি বানানো হয়েছিল। পরে চুক্তি বাতিল করা হয়। ওই প্রতিষ্ঠানকে অন্য যে সফটওয়্যার তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তা বহাল আছে।

তবে ১৪ কোটি তিন লাখ ৩৭ হাজার টাকার কয়েকটি কাজ করছে দেশীয় সফটওয়্যার কম্পানি রিভ সিস্টেমস। এর মধ্যে ‘স্পেলিং অ্যান্ড গ্রামার এরোর চেকার’-এর জন্য বরাদ্দ পাঁচ কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। অভ্র, নিকষ বাংলা (সরকারি অর্থায়নে তৈরি), অঙ্কুর, মজিলা অ্যাড অন, শুদ্ধ শব্দ, সৃষ্টি, গুগলসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান অফলাইন ও অনলাইনে বিনা মূল্যে ‘বাংলা স্পেলিং চেকার’ সেবা দিচ্ছে। সেখানে প্রায় একই জিনিস তৈরি করার জন্য ওই অর্থ বরাদ্দ করা হয়। পরে দেখা গেল রিভ সিস্টেমের সফটওয়্যার অন্যদের সোর্সকোড নিয়ে তৈরি।

বিজয় কি-বোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক এই তথ্য-প্রযুক্তিবিদ বলেন, ‘আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, বাংলা ভাষার ডিজিটাইজেশনে দীর্ঘসূত্রতা আমাদের ক্ষতি করছে। আমরা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হওয়ার জন্য আবেদন করেও হতে পারছি না। কারণ আমাদের মেশিন ট্রান্সলেশনসহ কারিগরি সক্ষমতা নেই। চার বছরে এই টুলগুলো উন্নয়ন করতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের এই ব্যর্থতা কাম্য ছিল না।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এন এম জিয়াউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। জটিল কাজ, তাই সময় লাগছে। এটি এখন শেষের দিকে। আশা করছি, এটি দ্রুত বাস্তবায়িত হবে।’

জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব করীম গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্পটি ২০১৭ সালের মার্চে শুরু হয়েছিল। এর অগ্রগতি মাপা কঠিন। যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বুয়েটে। বাস্তব অগ্রগতি হয়তো ৪০ শতাংশের মতো হবে। একটি কম্পোনেন্ট শেষ হয়েছে, আরো ছয়টির কাজ চলছে। এই ছয়টির মধ্যে তিনটির ডেমো রিলিজ হবে মাসখানেকের মধ্যে, বাকিগুলো আসবে জুন-জুলাই মাস নাগাদ। আর অবশিষ্ট টুলগুলো হতে ২০২৩ সালের জুন-জুলাই পর্যন্ত লাগতে পারে।’

অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘টিম ইঞ্জিনকে সোর্সকোড দিতে হবে, সেভাবেই চুক্তি হয়েছিল। টিম ইঞ্জিনের সঙ্গে চারটি কম্পানির কনসোর্টিয়ামে যারা আছে তারা কাজ করছে। অন্যদিকে রিভ সিস্টেমের একটি কাজ বাতিল হয়েছে। কারণ তারা ওপেন সোর্সের কোডকে তাদের কোড হিসেবে জমা দিয়েছিল।’

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি ও প্রকল্পটির বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য সৈয়দ আলমাস কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে অনেক আগে। এখানে দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে। এই প্রকল্পে যারা কাজ করেছিল, তাদের কিছু সমস্যা হয়েছিল। কারো কারো কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। একটা সময় নির্ধারণ করে এটাকে দ্রুত শেষ করা উচিত। আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ চাচ্ছি, সেখানে অনলাইনে মাতৃভাষার ব্যবহার বাড়াতে না পারলে এটি সফল হবে না।’

বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে প্রকল্পের পরামর্শক মো. মামুন অর রশীদ গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আমরা তা বাড়ানোর প্রস্তাব দিচ্ছি। বাংলা ভাষায় এমন কাজের নমুনা নেই, তাই সময় লাগছে। টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ নানা কারণে কিছুটা দেরি হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রি-টেন্ডার হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যারের কাজ দিয়েছিলাম রিভ সিস্টেমকে। তারা যে কোড দিতে চাচ্ছে তা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। তাই আমরা এটি বাতিল করেছি। আমরা মাসখানেকের মধ্যে রি-টেন্ডার (পুনঃ দরপত্র) দিতে পারব।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/02/22/1007303