২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, সোমবার, ২:৩৪

ট্রানজিটেও আসে না পানি

কুলিগিরির আদলে নামেমাত্র ভাড়ায় ‘ভারতের পণ্য ভারতে’ পরিবহন উজানে অনেক বাঁধ-ব্যারেজ দিয়ে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ আটকে রাখায় তিস্তা-পদ্মাসহ অভিন্ন নদ-নদীগুলো দ্রুতই শুকিয়ে তলানিতে : কৃ

ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ-শিল্পায়ন, মেগাপ্রকল্প, অবাকাঠামো উন্নয়নে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের আকার বেড়ে গেছে। সমানতালে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহনের চাপ ও চাহিদা বাড়ছে। বার্ষিক প্রায় ৩০ লাখ টিইইউএস (বিশ ফুটের ইউনিট হিসাবে) কন্টেইনার, সাড়ে ১০ কোটি মেট্রিক টন খোলা সাধারণ মালামাল, ৪ হাজার মার্চেন্ট জাহাজ হ্যান্ডলিং সামাল দিতে গিয়ে বন্দরের হিমশিম অবস্থা। ২০২০ সালে করোনাকালেও চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিবেশি ভারত, শ্রীলংকার বন্দরগুলোর তুলনায় বেশিহারে পণ্য হ্যান্ডেল করেছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতের ট্রানজিট পণ্যের প্রথম দফা ট্রায়াল রান হয়েছে। আরও ট্রায়ালের তোড়জোড় চলছে।

চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালন-পরিবহন সক্ষমতা ও সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটা এখন ব্যবহার করছে। সেখানে ভারতের বাড়তি ট্রানজিট পণ্যভার টানতে গেলে ভারসাম্য, ধারণক্ষমতা, দক্ষতা-সক্ষমতা হারাবে এমন আশঙ্কা পোর্ট-শিপিং সার্কেলের। তাছাড়া উত্তরে মীরসরাই থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার পর্যন্ত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে নির্মাণাধীন শিল্পাঞ্চল, অর্থনৈতিক জোনসমূহ চালু হওয়ার সাথে সাথে বন্দরের উপর আরও চাপ পড়বে। টার্মিনাল, ইয়ার্ড, শেড, ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামসহ দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা চাহিদা অনুপাতে কম।

ভারতের ‘বন্ধুত্বের আবদার’ পূরণে বন্দরে ট্রানজিট এবং বন্দর থেকে সরাসরি সীমান্তপথে পণ্য পরিবহনে করিডোর সুবিধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভারতের উজান থেকে আসছে না জীবনের অপর নাম- পানি। উজানে ভারত অনেকগুলো বাঁধ, ব্যারেজ, সেচপ্রকল্প দিয়ে আটকে রেখেছে পানির স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক স্রোতধারা। তিস্তা, ধরলা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, পদ্মাসহ অভিন্ন নদ-নদীগুলো দ্রুতই যাচ্ছে শুকিয়ে। শুষ্ক মওসুম শুরু হতেই নদ-নদী এমনকি এর সঙ্গে যুক্ত হাজারো খাল প্রায় পানিশূন্য হয়ে মরে যাচ্ছে।

মরুময় হয়ে উঠেছে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা। চরম সঙ্কটে পড়েছে কৃষি-খামার, ফল-ফসলের আবাদ ও উৎপাদন। অথচ গেল বছরে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার থেকে পাঁচ দফা বন্যায় ভেসেছে দেশের ৩২টি জেলা। ভারত নিজেদের বন্যামুক্ত রাখতে উজানের অববাহিকায় বাঁধ-ব্যারেজগুলো একযোগে খুলে পানি ছেড়ে দেয়ার পরিণামে বন্যা কবলিত হয় ভাটির দেশ বাংলাদেশ। আর শুষ্ক মওসুমে আগেভাগেই ভারত আটকে রাখে অভিন্ন নদীমালার পানি। স্বভাবতই জনমনে প্রশ্ন জাগে, এটাই কী ট্রানজিটের উল্টোফল?

ভারতের কলকাতা বন্দর থেকে ট্রানজিটের ট্রায়াল রানের জাহাজ ‘এমভি সেঁজুতি’ গত ২১ জুলাই-২০২০ইং চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এ জাহাজে আনীত কন্টেইনার ভর্তি রড এবং ডালের চালান সরাসরি করিডোর সুবিধায় নিয়ে যাওয়া হয় উত্তর-পূর্ব ভারতে। ইতোপূর্বে ‘পরীক্ষামূলক’ প্রথম ট্রানজিট পণ্য আনা-নেয়া হয় ২০১৫ সালের ২ জুন ‘এমভি ইরাবতী স্টার’ জাহাজযোগে। ভারতের বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতের তিনটি বন্দরে পরিবহন করা হয় এসব পণ্য।
একমুুখী বা একতরফা এই ট্রানজিটের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ‘ভারতের পণ্য ভারতে’ পরিবহন। ট্রানজিট সুবিধায় ব্যবহৃত হচ্ছে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর। তাছাড়া আখাউড়া ও বিভিন্ন স্থল সীমান্তপথ, স্থলবন্দর এবং রেল ও নৌপথে ভারত পাচ্ছে করিডোর সুবিধা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’ চুক্তি এবং চুক্তিটি বাস্তবায়নে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুসরণ করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বৈঠকে চ‚ড়ান্ত এসওপি স্বাক্ষরিত হয়।

ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে পণ্য পরিবহনে দীর্ঘ ঘুরপথ এড়িয়ে সময় ও খরচ বাঁচাতে ভারত চট্টগ্রাম বন্দরকে ট্রানজিট সুবিধায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই চুক্তিটি করেছে। যেমন-আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর দিয়ে করিডোর সুবিধায় উত্তর-পূর্ব ভারতে সম্প্রতি পরিবাহিত হয় ভারতের পণ্য। ১৫শ’ থেকে ১৭শ’ কিলোমিটার দুর্গম পথ পাড়ি না দিয়ে বাংলাদেশের সড়কপথে মাত্র ১৭০ কি.মি. দূরত্বে পৌঁছে যায় তাদের মালামাল।

এদিকে ট্রানজিটের বিনিময়ে কার্যত কুলিগিরির আদলে সার্ভিস দিয়ে ‘ভারতের পণ্য ভারতে’ পরিবহন করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ৭ ধরনের নামেমাত্র ফি আদায় হবে। এরমধ্যে আছে- প্রতি চালানের জন্য প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতিটনে ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, নিরাপত্তা ফি একশ’ টাকা, এসকর্ট ফি ৫০ টাকা, কন্টেইনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ফি একশ’ টাকা। নির্ধারিত ইলেকট্রিক লক ও সিল ফি প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের সড়কপথ ব্যবহার বাবদ সড়ক ও জনপদ বিভাগ নির্ধারিত মাশুল আদায় করবে। তবে সামগ্রিকভাবে এতে অস্পষ্টতা ও শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে। তাছাড়া দেশের সড়ক মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কসমূহ এমনিতেই সীমিত ও জরাজীর্ণ। তদুপরি করিডোর সুবিধা দিতে গিয়ে সড়ক মহাসড়কে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে এমন আশঙ্কা পরিবহনখাত সংশ্লিষ্টদের।

অন্যদিকে নিত্য ও ভোগ্যপণ্য, শিল্পপণ্য, আইটি, সেবাখাতে বাংলাদেশের উৎপাদিত শতাধিক ধরনের মানসম্পন্ন পণ্যের উচ্চ চাহিদা এবং বাজার সম্ভাবনাময় অঞ্চল উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘দ্য সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত সাতটি রাজ্য। যেমন- আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ছাড়াও সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, এমনকি তামিলনাডু-উড়িষ্যাসহ দেশটির অনেক অঞ্চল। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ট্রানজিটে ‘ভারতের পণ্য ভারতে’ পরিবহনের ফলে রফতানি সম্ভাবনা ভেস্তে গেছে। ট্যারিফ নন-ট্যারিফ (শুল্ক ও অশুল্ক) বাধায় বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে আগে ছিল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। এবার ট্রানজিট-করিডোরের কৌশলে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দার খান গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেছেন, অন্তরে গ্রহণ না করে মুখেই শুধু ‘বন্ধু’ ডাকলে তো হবে না। ন্যায্য প্রাপ্য না দিয়ে, উপকার নিয়ে উপকার না করলে বন্ধুত্বের ভিত্তি থাকবে নড়বড়ে। এটা লোকদেখানো অগভীর বন্ধুত্ব। বড়-ছোট যে রাষ্ট্রই হোক না কেন এ ধরনের বন্ধুত্ব নিছক লৌকিকতা। তা সত্য ভিত্তির ওপর টেকসই হয়না।

অথচ আমরা যেন বাধ্য হয়েই সন্তুষ্ট আছি। আমরা কী দিলাম কী পেলাম- গিভ অ্যান্ড টেকের ভিত্তিতে কড়ায় গন্ডায় হিসাব চাইছি না কেন? প্রাপ্য তালিকা যুক্তি সহকারে উত্থাপন করেছি কিনা? মুখ ফুটে চাইতে লজ্জা কোথায়? জনগণকে তা জানাতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, বিএসএফ বাংলাদেশের মানুষকে মারছে। আর ভারত বলছে ‘মানুষ মারার উদ্দেশ্য করে গুলি করিনি’! এসব মায়াকান্না দিয়ে বন্ধুত্ব হয় না।

https://www.dailyinqilab.com/article/359832