২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১:০৬

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে একুশের চেতনা হোক খাঁটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

আসিফ আরসালান : আজ রোববার অমর একুশে। মহান শহীদ দিবস। আজ থেকে ৬৯ বছর আগে এই দিনে বরকত, সালাম, জব্বার, শফিউলসহ সাবেক পূর্ব বাংলায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের রুহের প্রতি সালাম জানাচ্ছি। পরম করুণাময়ের কাছে মোনাজাত করছি তাদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য। বরকত সালামের রক্তদান বৃথা যায়নি। তাদের আত্মত্যাগের কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলা সাবেক পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। বাংলা শুধুমাত্র সাবেক পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসাবেই স্বীকৃতি লাভ করেনি। তার ১৯ বছর পর সাবেক পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান লাভ করেছে। জাতিসংঘ বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা দিয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে ৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির যে আশু লক্ষ্য ছিল, সেই লক্ষ্য তো সম্পূর্ণ পূরণ হয়েছেই, তার চেয়েও আরো অনেক বেশি কিছু প্রাপ্তি লাভ ঘটেছে একুশের চেতনাকে উজ্জীবিত রেখে। ভাষা আন্দোলনের পূর্ণ বিজয়ের কারণে পরবর্তীতে এটি শুধুমাত্র জাতীয় দিবসই নয়, বরং পরবর্তীতে উৎসবে পরিণত হয়। সেটি হলো জাতির বিজয়োৎসব। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই উৎসবের রূপ নিয়ে পালিত হয়ে আসছে শহীদ দিবস। এই একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতের পর থেকেই মানুষ উৎসবে মেতে ওঠেন। সময়টাও উৎসবের অনুকূল। ফাগুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে অপসৃয়মান শীতের মিষ্টি আমেজে শহীদ মিনারে গমন, সকাল হতেই হর্ষোৎফুল্ল লক্ষ মানুষের পদভারে শহীদ মিনার চত্বরে বিজয়ের আনন্দের হিল্লোল। যেসব তথাকথিত প্রগতিবাদী বন্ধুরা সবকিছুর মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা খুঁজে বেড়ান তারা একটি পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক দিবস পান এই একুশের মধ্যে। আনন্দের আতিশয্যে অনেকে বলেন, ২১ শে ফেব্রুয়ারি সমস্ত বাঙ্গালীর বিজয় দিবস। আবার ওরা শারদীয় দুর্গোৎসবকেও ‘বাঙ্গালীর উৎসব’ বলে চালিয়ে দেন। কিন্তু কঠিন সত্য হলো, শারদীয় দুর্গোৎসব হলো হিন্দুদের উৎসব। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আয্হা হলো মুসলমানদের উৎসব। একমাত্র পহেলা বৈশাখ অথবা পহেলা ফাল্গুন হলো জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত বাঙ্গালীর উৎসব।

শহীদ দিবস এপারের বাঙ্গালীদের, অর্থাৎ বাংলাদেশের ১৭ কোটি বাঙ্গালীর বিজয়োৎসব। সীমান্তের ওপারের ১০ কোটি বাঙ্গালীর বিজয়োৎসব নয়। শহীদ দিবসের দাবি হলো, অফিসে আদালতে, স্ট্যাম্প, মুদ্রাসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার। আপনি যদি কলকাতার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দরে নামেন, তাহলে সাথে সাথেই হোঁচট খাবেন। আপনি বাঙ্গালী- সেটা জানা সত্ত্বেও বিমান বন্দরের অবাঙ্গালী কর্মচারীরা তো বটেই, বাঙ্গালী কর্মচারীদেরও অধিকাংশ হিন্দিতে কথা বলবেন। এখন তো বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা, ব্যবসা বাণিজ্য এবং বেড়ানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে যান। তারা দেখেছেন এবং তাদের সুবাদে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ জেনে গেছেন যে কলকাতার রাস্তাঘাট এবং দোকান পাটে হিন্দির কি দাপট। দোকান পাট এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড হিন্দিতে, রেস্টুরেন্টে বাজছে হিন্দি গান। কথা-বার্তায়ও অর্ধেক মানুষ বাংলাতে, আর অর্ধেক মানুষ হিন্দিতে কথা বলছেন। বাংলাদেশের ঢাকার সাথে ভারতের কলকাতার কি অদ্ভুত বৈপরীত্য।

॥ দুই ॥
ভাষা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বর্তমান বিশ্বে সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বাহন টেলিভিশন। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলগুলির দিকে তাকিয়ে দেখুন। বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের যেসব চ্যানেল দেখেন তার মধ্যে ‘জি বাংলা’, ‘স্টার জলসা’, ‘কালারস বাংলা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া জি সিনেমা, স্টার মুভিজ প্রভৃতিতে সিনেমা দেখানো হয়। জি বাংলায় ‘সারেগামাপা’ নামে সঙ্গীতের একটি রিয়েলিটি শো হয়। বাংলাদেশের অনেক মানুষ এই অনুষ্ঠানটি দেখেন। দেড় ঘন্টার এই অনুষ্ঠান অন্তত ৬ জন উদীয়মান শিল্পী পারফর্ম করেন। প্রায়শই দেখা যায় ৬ জন শিল্পীই হিন্দি গান পরিবেশন করছেন। কোনো কোনো দিন হঠাৎ করে একটি বাংলা গান গাওয়া হয়। আর রবীন্দ্র সঙ্গীত? কবি গুরু বলতে যারা অজ্ঞান, তারা বিগত তিন মাস ধরে ঐ অনুষ্ঠানে একটি রবীন্দ্র সংগীতও পরিবেশন করেন নাই। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে বাংলাদেশের ৩০/৩২টি চ্যানেল সারাক্ষণ অনুষ্ঠান প্রচার করে, যার মধ্যে বেশির ভাগই থাকে রবীন্দ্র সঙ্গীত। কিন্তু পহেলা বৈশাখ পশ্চিমবঙ্গের চ্যানেলগুলো খুলুন, দেখবেন একটি কি দুইটি প্রোগ্রাম আছে, কি নাই।

বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ মনে হয়, বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব। রাস্তাঘাটে, হাটে মাঠে বাটে সর্বত্র পহেলা বৈশাখের ফাংশন। আপনি পহেলা বৈশাখ কলকাতা থেকে দেখুন তো, বাংলাদেশের উৎসবের ব্যাপ্তির কণামাত্র সেখানে পান কি না। অথচ ওরা বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে কতই না বড়াই করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি তথা শহীদ দিবসকে সঙ্গী করে বাংলাদেশে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমি একাধিকবার পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছি। সবশ্রেণীর মানুষের সাথে মেলামেশা করেছি। কোথাও যদি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আকার ইঙ্গিত দিয়েছি তো ওরা আঁতকে উঠেছেন। বিস্মিত হয়ে বলেছেন যে, “বলেন কি দাদা, আমরা আগে ভারতীয়, তারপর বাঙ্গালী। ভারত আমাদের মাতা।”

পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনগোষ্ঠী মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ। সেই তুলনায় হায়দরাবাদ তথা তেলেঙ্গনার মুসলিম জনগোষ্ঠী ১০ শতাংশেরও কম। আামি সেখানেও দুইবার গিয়েছি। হায়দরাবাদ, সেকান্দারাবাদ প্রভৃতি মহানগরীতে দেখেছি, মুসলমানরা মাথা উঁচু করে চলাফেরা করেন। প্রিয় পাঠক, শহীদ দিবসের গৌরবগাঁথা বর্ণনা করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কথা এই বিষয়টি জোরের সাথে বলবার জন্যই বললাম যে একুশ তথা শহীদ দিবস আমাদের অহংকার। শহীদ দিবস বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের বিজয় উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের নয়।

॥ তিন ॥
প্রতিবার শহীদ দিবস আসে, আর আমরা একটি আওয়াজ প্রতিবারই শুনি যে, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। এটাকে বলা যায় একুশের চেতনা। যদিও ২১ মূলত ছিল ভাষার আন্দোলন, কিন্তু সেটি শুধুমাত্র ভাষার দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের সময় পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় ছিল মুসলিম লীগ। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নূরুল আমীন। সুতরাং রক্তাক্ত ২১ এর দায় পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের ঘাড়ে পড়ে। এর ভয়াবহ ফল দেখা যায় ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ওপর। ঐ নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। নেতুত্বে ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী এবং ফজলুল হক ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি। ১৯৫৪ সালের এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। বলা বহুল্য, মুসলিম লীগের এই ভরাডুবির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল ৫২ এর রক্তঝরা ২১ ফেব্রুয়ারি। এখানে বলা দরকার যে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী মেনিফেস্টো ছিল ঐতিহাসিক ২১ দফা। ২১ দফার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দফা ছিল পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। এরপর যতবার একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে প্রতিবারই পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হয়েছে। যাই হোক, নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতি অতিবাহিত হয়েছে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী বছর গুলোতে যতবার একুশ এসেছে, ততবারই স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। এবং প্রতিবারই শহীদ দিবসে একটি বাক্য উচ্চারিত হয়েছে। আর সেটি হলো, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে আমরা উপনীত হয়েছি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আজ উদ্যাপিত হচ্ছে মহান একুশে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতেও কি একুশের সেই শপথের অবসান হয়েছে? সেই শপথ যার কয়েকটি বাক্য হলো, একুশ মানে মাথা নত না করা। শোষকগোষ্ঠী আর আধিপত্যবাদের কাছে মাথা নত না করা।

॥ চার ॥
স্বাধীন বাংলাদেশে আধিপত্যবাদের রং ও রূপ বদলে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী আধিপত্যের স্থানে এসেছে ভারতীয় আধিপত্য। পাকিস্তানে জনগণ খাঁটি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি। একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে লেগেছে ৯ বছর। সেই সংবিধান কার্যকর হওয়ার দুই বছর পর সারা পাকিস্তান জুড়ে জারী করা হয় মার্শাল ল’। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর উনসত্তরে জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সংঘঠিত হয় গণঅভ্যুত্থান। আসেন আরেক সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বরিশালে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বিএনপি নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর হাফিজ বলেছেন যে এই সরকার সামরিক সরকারের চেয়েও কঠোর সরকার। বিএনপিসহ বিরোধী দলের সকলেই বলছেন, দেশে গণতন্ত্র নাই। দেশে অঘোষিত এক দলীয় শাসন কায়েম হয়েছে। এখন প্রয়োজন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আধিপত্যবাদের অবসান।

একুশের চেতনার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। গণতন্ত্র মানুষের রক্তে মিশে আছে। আজ ২১ এর চেতনা হোক গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সব রকমের আধিপত্যবাদের অবসান। তবে সেটা হবে গণতান্ত্রিক পথে, নিয়মতান্ত্রিক পথে, শান্তিপূর্ণ পথে। বাংলাদেশ কায়েম হয়েছে গণতন্ত্রের স্বাদ উপভোগের জন্য।
asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/444481