২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:১৯

দখল-দূষণে বেহাল তুরাগ

উচ্ছেদের পরই হয়ে যাচ্ছে দখল : পানির রঙ কালো, তীব্র দুর্গন্ধ নদ-নদী রক্ষায় সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন : অধ্যাপক ডা. হাফিজা খাতুন দখলমুক্ত নদ-নদীর জমির পুনর্দখল ঠেকাতে কাজ চলমান

উচ্ছেদের দেড় বছরের মধ্যে আবার দখল হয়ে গেছে তুরাগ নদের তীর। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ নদের তীরবর্তী জমির মালিকদের সাথে তিন সরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিয়ে অবৈধ দখলদারীরা পুনরায় দখল নিয়েছে। আব্দুল্লাপুর রেলগেইট থেকে গাবতলী পর্যন্ত বেড়িবাঁধসহ তুরাগ তীরে অবৈধ দখলদারের সংখ্যা প্রায় এক হাজার একশ’ জন। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত তুরাগ তীরে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ৮০ শতাংশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিল বিআইডব্লিউটিএ।

এখন অনুসন্ধান বলছে, দখলমুক্ত করার পর স্থায়ী সীমানা পিলার অতিক্রম করে আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে তুরাগ। টঙ্গী রেলওয়ে থেকে গাবতলী ব্রিজ পর্যন্ত বেড়িবাঁধ ও তুরাগ তীর ঘেঁষে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে ১১ শতাধিক কাঁচা-পাকা ঘর, দোকানপাট, হাটবাজার, গাড়ির স্ট্যান্ড, স্থায়ী ভবনসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান করে তুরাগ দখলে রেখেছে প্রভাবশালী মহল। তবে তুরাগ নদের ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়্যারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, দখলমুক্ত নদের জমির পুনর্দখল ঠেকাতে কাজ চলমান রয়েছে।

বারবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেও তুরাগ নদ দখল ও নদের প্রবাহ বজায় রাখতে না পারার কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলেছেন, বিআইডব্লিউটিএ’র লোকজন হঠাৎ হঠাৎ এসে উচ্ছেদ করে যায়, কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনো তদারকি করে না। তাই উচ্ছেদের পর আবারো দখল হয়ে যাচ্ছে নদীতীর।

জানতে চাইলে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন গবেষক ড. ফাতেমা রোকশানা বলেন, ২০১৫ সালে ঢাকার নদীগুলো নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হয়। তখন তুরাগের ওয়াকওয়ে ও সিঁড়ির ওপর ময়লার স্তূপ দেখা গেছে। এখনো একই অবস্থা। যেখানে ‘ময়লা ফেলা যাবে না’ সাইনবোর্ড লেখা থাকে, মানুষ সেখানেই ময়লা বেশি ফেলে। ওয়াকওয়ে বা সিঁড়ির ওপর ময়লা ফেললে ক্ষতিটা হয় বেশি। আবর্জনাটা তখন পচতে সময় নেয় ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত করে ফেলে। সরকারের ভালো ও প্রশংসনীয় পরিকল্পনাও সঠিক বাস্তবায়ন ও তদারকির অভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

রাজধানীর গাবতলীর কাছে পালপাড়া ঘাট থেকে শুরু করে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরলে প্রথমেই পালপাড়া ঘাটে দেখা যায় বিশাল এক পাইপের মাধ্যমে কীভাবে ড্রেনের ময়লা পানি ও বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। পানি এখানে এতটাই দূষিত যে, তীরের পাশের ইটগুলো পর্যন্ত কালো রঙ ধারণ করেছে। পাশাপাশি দুর্গন্ধের তীব্রতার কথা না বললেই নয়। আর একটু এগোতেই দেখা মেলে নদীর পাশে লাউ শাক, সিম এগুলোর সারি সারি মাচা। এগুলো খাওয়া কতটা স্বাস্থ্যকর তাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

বেশ কয়েকজন নারীকে দেখা গেল এ কালো পানি দিয়েই কাপড় ধুচ্ছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো শিশুরা এ নদীর আশেপাশে চরম অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খেলাধুলা করছে, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির নির্দেশক। প্রতিনিয়ত বালুবাহী কার্গো থেকে বিপুল পরিমাণ তেল-বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে। এর একটু সামনে বেদের টেক ঘাটের পাশে বিশাল বিশাল ময়লার স্তূপ। নৌকার মাঝিসহ স্থানীয়রা জানালেন, এর জন্য সাধারণ মানুষই দায়ী। কাউন্দিয়া ঘাট ও তার আশেপাশে নদীর তীরে এক সঙ্গে চলছে মানুষ এবং ছোট ছোট চতুষ্পদ জন্তুগুলোর নিত্য আনাগোনা। মানুষ এখানে পায়ে হেঁটে নৌকায় উঠছে আর ওরা নদীর পাড়ের ময়লার স্তূপে দল বেঁধে খাবার খুঁজছে।

তুরাগ নদের প্রবাহ ঠিক রাখতে এবং তীর দৃষ্টিনন্দন করতে সরকার প্রায় ৩৮ কোটি টাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। পাঁচ বছর আগে বাস্তবায়িত সেই প্রকল্প খুব একটা কাজে আসছে না। অযত্ম-অবহেলা, দখল আর দূষণে ফের আগের দশায় ফিরছে তুরাগ। সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর পাড় বরাবর নির্মাণ করা হয়েছে হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে। রাস্তা থেকে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে রয়েছে আরসিসি সিঁড়ি। নদীতীর সংরক্ষণের পাশাপাশি সৌন্দর্য বর্ধনে কিউ ওয়াল নির্মিত হয়েছে। এসব নির্মাণকাজ শুরুর আগে উচ্ছেদ করা হয় নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনাও।

এতসব আয়োজন ঢাকার উত্তর প্রান্ত ঘিরে থাকা তুরাগ নদের প্রবাহ ঠিক রেখে দৃষ্টিনন্দন তীর গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। এ জন্য ৩৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। তবে এরই মধ্যে অযত্ম আর অবহেলায় ধীরে ধীরে আগের দশায় ফিরতে শুরু করেছে তুরাগ তীর।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দখলে-দূষণে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে তুরাগের পানি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ও স্থানীয় মানুষের ফেলা আবর্জনায় তুরাগ নদের মৃত্যু এখন সময়ের ব্যাপার। যদিও এ দূষণ রোধে প্রথমে নদীর তীরবর্তী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়, তারপর আরসিসি সিঁড়িসহ হাঁটার রাস্তা, কিউ ওয়াল ও তীর সংরক্ষণসহ মোট পাঁচ ধরনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় তুরাগ নদের টঙ্গী ও ঢাকা প্রান্তে। দখল উচ্ছেদ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এসব ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করেছে।

এতে টঙ্গী অংশে ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ও ঢাকা অংশে ১৭ কোটি ২৮ লাখ ১১ হাজার টাকা। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দ্রুতই জীর্ণ হয়ে পড়ছে নির্মিত স্থাপনাগুলো। উল্টো এসব অবকাঠামোর ওপরেই চলছে নানা কর্মকান্ড।

টঙ্গী ও ঢাকা প্রান্তের মোট ৩ হাজার ৩৮০ মিটার দীর্ঘ হাঁটার রাস্তার অনেকটাই দখল করে রাখছেন হকাররা। ওয়াকওয়ের ওপরই দেখা গেল কয়েকটি ছাগল বিক্রির জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন মজনু মিয়া নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি জানালেন, মানুষ এ পথে হাঁটাচলা করে। পথ চলতে ছাগল দরদাম করে। তাই এখানেই বসেছি। পাশেই কামারের দুটি দোকান। ওয়াকওয়ের ওপর ব্যবসা করা অনৈতিক স্বীকার করে তাদের একজন বললেন, পেটের দায়ে করি। এখানে কাউকে ভাড়া দিতে হয় না।

কামারদের দোকানের ভাড়া দিতে না হলেও উল্টোপাশে যেখানে আগে টঙ্গীবাজার ছিল, সেখানকার দোকানীদের দিতে হয় অর্থ। মাছ-গোশত-মসলাসহ বিভিন্ন পণ্যের প্রায় শ’খানেক দোকান রয়েছে ওই এলাকায়। মসলার দোকানী আসিফ বলেন, আগে এখানে বাজার ছিল। বিআইডব্লিউটিএর লোকজন তা ভেঙে দিয়েছে। এখন সিটি করপোরেশনের লোকজনকে দৈনিক ৬০ টাকা খাজনা দিয়ে দোকান করছি আমরা। টঙ্গী ব্রিজের পাশেই একটি পাঁচতলা ভবন গত বছর বিআইডব্লিউটিএ’র অভিযানে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। সে ভবনের জায়গায় এখন নার্সারির ব্যবসা করছেন আকতার হোসেন।

সরেজমিন তুরাগ তীরে গিয়ে দেখা যায়, নতুন বানানো আরসিসি সিঁড়িতে সারি সারি কাপড়ের স্তূপ। ১০টি ড্রামে মা-ছেলে কাপড় ধুচ্ছেন। ধোয়ার কাজে তাদের সঙ্গে রয়েছেন আরো তিনজন। টঙ্গী ও ঢাকার দুই পাশে ওয়াকওয়ের রেলিং বেশ কয়েক জায়গায় ভেঙে পড়েছে। কোথাও বা স্থানীয় দোকানী ও এলাকাবাসী নিজেদের সুবিধামতো তা ভেঙে নিয়েছে। রাস্তাও ভেঙে গেছে অনেকখানি। তবে বেশ কয়েকটি আরসিসি সিঁড়ি অক্ষত দেখা গেছে। অক্ষত থাকার মূল কারণ হলো সেগুলো মানুষ ব্যবহার করে না। তীর সংরক্ষণের সীমানা ও নদীর পুরো অংশই ময়লা-আবর্জনায় একাকার। তবে অব্যবহৃত আরসিসি সিঁড়ির ওপর ময়লার বিশাল স্তূপ দেখা গেছে। যেন এসব সিঁড়ি ময়লা ফেলার জন্যই নির্মাণ করা হয়েছিল।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অল্প কয়েকটি সীমানা খুঁটি এখনো রয়ে গেছে। অনেক সীমানা খুঁটিই ভেঙে গেছে বা ভেঙে ফেলা হয়েছে। যদিও বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে গত বছর নতুন করে ১০০ বছর মেয়াদি সীমানা খুঁটি নির্মাণ করা হয়েছে। খুব মজবুত হওয়ায় সেগুলো ভাঙা সম্ভব হয়নি। ভাঙতে না পেরে এসব খুঁটির পাশেই বাড়ি, ঘর, দোকানপাট নির্মাণ করেছে দখলদাররা। ওয়াকওয়ের পাশ ঘেঁষে কোনো বসতভিটা কিংবা স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ না থাকলেও তুরাগের দুই পাশেই আইন অমান্য করে গড়ে উঠেছে বসতভিটা ও দোকানপাট।

প্রসঙ্গত, তুরাগ নদের টঙ্গী ও ঢাকা প্রান্তে হাঁটার রাস্তা, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে, কিউ ওয়াল, তীর সংরক্ষণ এবং আরসিসি সিঁড়িসহ পাঁচ ধরনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এ ব্যয়ে তুরাগ নদের টঙ্গী প্রান্তে হাঁটার রাস্তা ১২৯০ মিটার, তীর সংরক্ষণ ১২৯০ মিটার, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে ৬৭৫ মিটার, কিউ ওয়াল ৩৩৫ মিটার এবং ১৫টি আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে তুরাগের ঢাকা প্রান্তে নির্মাণ করা হয় হাঁটার রাস্তা ২০৯০ মিটার, তীর সংরক্ষণ ২০৯০ মিটার, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে ৬২৫ মিটার এবং আরসিসি সিঁড়ি ১৮টি।

জানা গেছে, দূষণ রোধে তুরাগসহ ঢাকার চার নদ-নদীর প্রবাহ বজায় রাখতে ২০১১ সালের ২৯ মার্চ ৯৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। ‘ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গী নদীবন্দরের উচ্ছেদকৃত ফোরশোর ভূমিতে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক এ প্রকল্পের কাজ ২০১৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও একদফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৪ সালের জুন নির্ধারণ করা হয়। বর্ধিত মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ায় তৃতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়নে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃতীয় মেয়াদে নির্মাণকাজ শতভাগ সমাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে নির্ধারিত বাজেটের চেয়ে ২৮ লাখ ২৭ হাজার টাকা কম খরচ হয়। ১০৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা অনুমোদিত বাজেটের বিপরীতে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১০৭ কোটি ৫৩ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

জানতে চাইলে পরিবেশবিদ অধ্যাপক ডা. হাফিজা খাতুন বলেন, পরিকল্পনা নেয়ার সময় তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়টিও ভেবে দেখা উচিত। ওয়াকওয়ে নির্মাণের সময় এটার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতের পরিকল্পনা নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএ’র যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি স্থানীয় প্রশাসনেরও দায়িত্ব আছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/360379/