২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:১১

সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদন

সরকারি ব্যয়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম

সরকারি অর্থ ব্যয়ের মধ্যে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। সিএজির সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে (২০১৬-১৭) উঠে এসেছে এমন তথ্য। অর্থাৎ গত নিরীক্ষার (২০১৫-১৬) তুলনায় অনিয়মের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ব্যাংকিং খাতে রয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।

বাকি ১৩ হাজার ৫শ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক অনিয়মের পরিমাণ হচ্ছে ৪ হাজার কোটি টাকা। আর সড়ক ও পরিবহণ খাতে হচ্ছে পৌনে চার হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাখিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা গেছে, সিএজির সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৮ (১) ও ১২৮ (৪) এবং দি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (এডিশনাল ফাংশন) অ্যাক্ট ১৯৭৪-এর ধারা ৪ ও ৫ ক্ষমতাবলে জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের জন্য শিগগিরই রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হবে।

অডিট রিপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত জানতে সোমবার বিকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মোবাইল ফোনে কল করা হলে সাড়া পাওয়া যায়নি। এর আগে বৃহস্পতিবার একই নম্বরে (ওয়াটস অ্যাপ) ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু সোমবার রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর আসেনি। জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সিএজির আর্থিক অনিয়ম রিপোর্টগুলো গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করা দরকার।

সংশ্লিষ্টদের কাছে এর জন্য জবাব চাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি পর্যালোচনা করে এই অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিত হলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, অবশ্য এসব আর্থিক অনিয়ম রিপোর্টগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আর্থিক অনিয়ম আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। কেন এমন হলো এটি দেখতে হবে। এর প্রথম কারণ হচ্ছে বিগত সময়ে আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

দায়ীদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে কারণে অনিয়মের পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে সাধুবাদ জানানো দরকার অডিট বিভাগকে। এই সংস্থাটি আর্থিক অনিয়ম উদঘাটন করেছে। তিনি বলেন, এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্ব এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা। না হলে ভবিষ্যতে আর্থিক অনিয়মের পরিমাণ আরও বাড়বে।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ বছর ২৪টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অর্থ ব্যয়ের ওপর নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সিএজি অফিস। নিরীক্ষা কার্যক্রমে আর্থিক অনিয়ম উদঘাটন হয় ২৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। এটি চলতি বাজেটের ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের সিএজির নিরীক্ষা কার্যক্রমে উদঘাটিত আর্থিক অনিয়মের পরিমাণ ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

গত অর্থবছরের তুলনায় আর্থিক অনিয়মের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতেও অনিয়মের পরিমাণ বেড়েছে। গত বছর আর্থিক খাতে অনিয়মের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। এ বছরের রিপোর্টে দেখা গেছে সেটি প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র আরও জানায়, এসব অনিয়মের মধ্যে ১৭টি মন্ত্রণালয়ের অর্থ ব্যয়ের ওপর বার্ষিক নিরীক্ষা কার্যক্রমে ২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে। পাশাপাশি ৩টি মন্ত্রণালয়ের ওপর বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা অনিয়ম ধরা পড়ে ২১ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। সিএজি কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সুপারিশ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে শিথিলতা আছে।

এছাড়া অডিটের সুপারিশ বাস্তবায়নে কম গুরুত্বারোপ করা হয়। পাশাপাশি কার্যকর অভ্যন্তরীণ অডিটের অনুপস্থিতি, সুশাসনের ঘাটতি এবং বাজেট প্রাক্কলন ও বাস্তবায়নে সক্ষমতার স্বল্পতা রয়েছে। যে কারণে একদিকে একই বিষয়ে অডিট পুনরাবৃত্তি হচ্ছে অন্যদিকে অডিটের সংখ্যাও বাড়ছে।

রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উদঘাটিত আর্থিক অনিয়মের অর্ধেক হয়েছে ব্যাংকিং খাত ঘিরে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ ব্যাংক (আইসিবি) ওপর চারটি নিরীক্ষায় ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। সাধারণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পর খেলাপি হওয়া, শর্তভঙ্গ করে ঋণ গ্রহণ ও জাল অ্যামেন্ডমেন্টের মাধ্যমে ব্যাংক টু ব্যাংক এলসি ও পিসি সুবিধা নেওয়ার মাধ্যমে অনিয়ম হয়েছে।

অনিয়মের মধ্যে আরও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঋণের অর্থ আদায়ে তদারকির অভাবে ক্ষতি, এলটিআর মঞ্জুরের পর পাওনা অর্থ আদায় না হওয়া, জামানত ছাড়া এলটিআর ঋণ মঞ্জুরের মতো অনিয়ম। এছাড়া অনিয়ম ফিরিস্তিতে রয়েছে বন্ধ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায়ে ব্যর্থ, অনাদায়ী ঋণের ওপর পুনরায় ঋণ ইস্যু।

এ বছর বিদ্যুৎ বিভাগের ওপর নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় আওতাধীন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এরপর চারটি রিপোর্ট করা হয়। এখানে আর্থিক অনিয়মে জড়িতের পরিমাণ হচ্ছে ৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগে গত অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ২৩ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এই অনিয়ম মোট বাজেটের ১৭ শতাংশ।

অনিয়মের কৌশল প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজার দর যাচাই না করেই শিডিউলের বাইরের পণ্য কেনা হয়। এছাড়া রের্কড গায়েব করে সম্পত্তি অবৈধ দখলদারের কাছে হস্তান্তর হয়েছে। প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ও বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে মালামাল কেনার মাধ্যমেও টাকা আ ত্মসাৎ করা হয়।

একইসময়ে একই অফিসে কাজ করে দুটি পৃথক সরকারি অফিস থেকে বেতন নিয়ে টাকা আ ত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণের অভাব ছিল।

যে কারণে এসব অনিয়ম করতে পেরেছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক খাতে আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে ৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/395711