২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:১০

হল খোলা নিয়ে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

ঢাবিতে আজ জরুরি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সভা; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা

দেশে গত বছরের মার্চে হানা দেয় করোনাভাইরাস। এর কয়েকদিনের মধ্যেই অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে বিভিন্ন সময় বারবার ছুটির সময় বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত বন্ধই রাখা হয়। একপর্যায়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা হলে ফেরার অনুমতি পায়নি।
সম্প্রতি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দেয়। এতে শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও হল না খোলায় বিপাকে পড়েন তারা। এর প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস খুলে দেয়ার দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে জাহাঙ্গীরনগরে স্থানীয়দের সাথে অপ্রীতিকর এক ঘটনার জেরে শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে প্রবেশ করে হলে। এরপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। গতকাল শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি এ বিষয়ে এক নির্দেশনা জারি করার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সকল স্তরের চলমান পরীক্ষা স্থগিত করেন। শিক্ষামন্ত্রীর এ ঘোষণার পরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় ঢাবিতে আজ জরুরি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সভা বসছে।

উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা জানান, আবাসিক হল খোলার দাবিতে গতকাল সোমবার সকাল থেকেই আন্দোলন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে গতকাল দুপুরে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থীরা জোর করে হলে ঢুকে পড়েছিল। এ সময় অমর একুশে হলেও প্রবেশ করতে দেখা যায় কিছু শিক্ষার্থীকে। এরপর বেলা ৩টায় মানববন্ধন ও মিছিল করতে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ‘মোদের দাবি একটাই, হল সব খোলা চাই; এক দফা এক দাবি হল খুলবে ফেব্রুয়ারি’ স্লোগান দেন তারা। মানববন্ধনে হল খোলার জন্য নির্দেশ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র জুনাইদ হুসেইন খান বলেন, সেশনজট যাতে আর দীর্ঘায়িত না হয়, সেজন্য আমরা মার্চ থেকে হলে উঠতে চাই। আমরা ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিচ্ছি না, কারণ প্রশাসনিক অনেক বিষয় আছে। ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিচ্ছি, এর মধ্যে মার্চে হল খোলার বিষয়ে লিখিতভাবে নোটিশ দিতে হবে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নিজ কার্যালয়ে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলন করেন ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। এ সময় তিনি বলেন, সরকার শিক্ষার্থীদের ভ্যাক্সিনেশনে আওতায় আনার একটি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নির্দিষ্ট তারিখ দিয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা হল খোলার দাবি তুলছে সব বিষয় মিলে আমরা আগামীকাল (আজ) ১০টায় একটি জরুরি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সভা করব সেখানে মূল সিদ্ধান্ত আসবে।

শিক্ষার্থীদের কঠিন অবস্থায় আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা সত্য যে শিক্ষার্থীদের উপর চাপ অনেক, এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এই অবস্থায় থাকা কঠিন, তাই আমরা এককভাবে হলেও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষার্থীদের অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে আমরা একটা সমাধানে আসব।

এদিকে ভিসির আশ্বাসে আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিতের কথা জানিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, ভিসি আগামীকাল একটা জরুরি সভা ডেকেছেন। সেখানে যদি মার্চ মাসে হল খোলার সিদ্ধান্ত না হয় তাহলে আমরা আবার আন্দোলনে নামব।

জাবিতে হলে থাকার বিকল্প নেই
জাবি সংবাদদাতা জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে হলে অবস্থান করছে জাবি শিক্ষার্থীরা। হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হলেও তারা ক্যাম্পাস ছাড়তে নারাজ। শিক্ষার্থীরা বলছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আলাদা, তারা ক্যাম্পাসের বাইরে নিরাপদ নয়। তাই হলে থাকার বিকল্প নেই।
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী শারমীন আক্তার সাথী বলেন, ‘আমরা শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যকে সাধুবাদ জানাই। তবে জাহাঙ্গীরনগরের পরিস্থিতি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো না। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে। যা মোটেই জাবির শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ না। ফলে আমরা হলে অবস্থানের সিদ্ধান্তে এখনো অটল আছি এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ছাত্রী হলেও শিক্ষার্থীরা উঠবে।

এর আগে সোমবার দুপুর ১২টার দিকে ছেলেদের আটটি হলে যান হলের প্রাধ্যক্ষসহ হল প্রশাসন। তারা শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, গ্রামবাসীর হামলার ৪৮ ঘণ্টা পার হলেও হামলাকারীদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ অবস্থায় গেরুয়ায় আবার যাওয়া নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত না করা পর্যন্ত হল ত্যাগ করা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, হল প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ না করার ঘোষণা দিলে তারা ফিরে আসেন।

অনড় ইবি শিক্ষার্থীরা
ইবি সংবাদদাতা জানান, আবাসিক হল খুলে দেয়ার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় ক্যাম্পাসের ডায়না চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে তারা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে মিলিত হয়। সেখানে দুই ঘণ্টা অবস্থান করে তারা। এ সময় শিক্ষার্থীরা হল খোলার দাবিতে বিভিন্ন সেøাগান দেয়। পরে শিক্ষামন্ত্রী কর্তৃক ১৭ মে আবাসিক হল খোলার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানায় তারা। এছাড়া আজ মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে বলে জানান শিক্ষার্থীরা।

এদিকে সন্ধ্যায় বিশ^বিদ্যালয়ের চলমান ও অনুষ্ঠিতব্য সব পরীক্ষাসমূহ স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ^বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আতাউর রহমান। এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ^বিদ্যালয়ের চলমান ও অনুষ্ঠিতব্য বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষাসমূহ স্থগিত করা হয়েছে।

আলটিমেটাম রাবি ও শাবিতে : ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলো খুলে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ মিছিল ও ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শিক্ষার্থীরা। একই কর্মসূচি পালন করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ে (শাবি) শিক্ষার্থীরা।
রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন মার্কেটের আমতলা থেকে রাবি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি ক্যাম্পাসের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ভিসি অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচিতে মিলিত হন। এ সময় অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন। চলতি মাসেই আবাসিক হলগুলো খোলার ঘোষণা না দিলে আজকের এ আন্দোলন থেকেই তারা কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার হুমকি দেন। শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণার প্রেক্ষিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, মঙ্গলবার হল খোলা প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সাথে ইউজিসির বৈঠক রয়েছে এবং আগামীকাল রাবিতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের’ স্টিয়ারিং কমিটির নির্বাচন রয়েছে। এই কারণে দুই দিনের জন্য আন্দোলন স্থগিত করা হলো; তবে আগামী মার্চের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীরা হলে প্রবেশ করবে বলে ঘোষণায় জানানো হয়।

অন্যদিকে মঙ্গলবারের মধ্যে আবাসিক হল খুলে দেয়ার দাবিতে প্রশাসনকে আলটিমেটাম দেয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দাবি না মেনে নিলে কঠোর আন্দোলনেরও ঘোষণা দেন তারা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছে শাবি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট।

খোলা আকাশের নিচে ববি শিক্ষার্থীদের রাতযাপন : ক্যাম্পাসের বাইরে এবং বিভিন্ন মেসে নিরাপত্তাহীনতার কারণে আবাসিক হল খুলে দেয়ার দাবিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) প্রশাসনিক ভবনের নিচে খোলা জায়াগায় রাতযাপন করেছে কিছু শিক্ষার্থী। রোববার রাতে তাদের খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করতে দেখা গেছে। হল খুলে না দেয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাসে খোলা জায়গায় রাতযাপন অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অথচ আবাসিক হল খুলে না দেয়ায় শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছে। বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরা নানাভাবে নির্যাতন এবং ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে। এই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবনের নিচে রাতযাপন অব্যাহত থাকবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/564592/