২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:০৯

পায়রা নদীতে সেতু নির্মাণ

ঠিকাদার নিয়োগেই পৌনে ৪ বছর

পৌনে ৫ বছরের প্রকল্পের ৮ বছরে অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ; ২ দফায় খরচ বেড়েছে ১০৩৪ কোটি টাকা

অনুমোদনের পরই শুরু হয় কোনো প্রকল্পের ডিজাইন ও নকশা তৈরি এবং এর বিভিন্ন পরিবর্তন। আর ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগেই পেরিয়ে যায় প্রকল্পের বেশির ভাগ মেয়াদ। ফলে নির্ধারিত মেয়াদ ও খরচে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বছরের পর বছর টানতে হয় প্রকল্পটি। একই রোগে আক্রান্ত হয়েছে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে পায়রা নদীর ওপর পায়রা সেতু (লেবুখালী) নির্মাণ প্রকল্পটি। অনুমোদনের পর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নিয়োগে তিন বছর ৮ মাস বিলম্ব এবং মূল সেতুর ডিজাইন ও নদীতীর রক্ষা কাজের ডিজাইনে অতিরিক্ত ১৪ মাস সময় ব্যয় হওয়ায় বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে বলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এবং আইএমইডি সচিব জানান।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রের তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ উন্নয়নে বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কে লেবুখালীর পায়রা সেতুর নির্মাণের স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষায়। ৪১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নেয়া চার বছর ৮ মাসে প্রকল্পের আওতায় সেতুর কাজ ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। দফায় দফায় পরিবর্তন করা হয় প্রকল্পটিতে। প্রকল্প অনুমোদনের পর ডিপিপি দু’দফা সংশোধনের পর মূল সেতুর ভিত্তির ডিজাইন পরিবর্তন, নদীর তীর রক্ষা কাজের ডিজাইন পরিবর্তন, সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির কারণে সর্বশেষ ডিপিপি সংশোধন করা হয়। এখন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে এক হাজার ৪৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

প্রকল্পের আওতায় মূল কার্যক্রম ছিল, এক হাজার ৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্যরে (ভায়াডাক্ট সেতু ৮৪০ মিটার এবং মূল সেতু ৬৩০ মিটার) ও ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার প্রস্থের চারলেন বিশিষ্ট সেতু নির্মাণ, এক হাজার ২৬৮ মিটার (বরিশাল প্রান্তে ৬১০ মিটার ও পটুয়াখালী প্রান্তে ৬৫৮ মিটার) সংযোগ সড়ক, এক হাজার ৪৭৫ মিটার তীর রক্ষাপ্রদ কাজ এবং কম্পিউটারাইজড টোল প্লাজা। এই সেতু নির্মাণের উদ্দেশ্য পায়রা মহাসমুদ্রবন্দর ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রা ও অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কুয়াকাটাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সাথে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপন সহজ হবে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বরিশাল-পটুয়াখালী জাতীয় মহাসড়কের মাঝে পায়রা নদী থাকায় যানবাহনগুলোকে ফেরি পারাপারের মাধ্যমে চলাচল করতে হয়। পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য কুয়েত সরকারের ৩৩৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা ঋণে মোট ৪১৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ৮ মে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চার বছর আট মাসে প্রকল্প সমাপ্ত করার কথা। পরবর্তীতে ভূমি অধিগ্রহণের ব্যয় বৃদ্ধি, ভ্যাট ও আইটি খাতে ব্যয় সমন্বয়ের জন্য ২০১৫ সালের ৩১ মে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এতে খরচ বেড়ে হয় ৪১৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এখানে ব্যয় ১.২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এর দু’বছর পর আবার সংশোধন করা হয়। পূর্তকাজের চুক্তিমূল্য অনুযায়ী অতিরিক্ত ব্যয়, নতুন ঋণচুক্তি প্রভৃতি বিষয় যুক্ত করে প্রকল্পের খরচ আট শ’কোটি টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ২৭৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা করা হয় ২০১৭ সালের ২০ জুন। এইবার ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল ২০৯. ৪৩ শতাংশ। আর মেয়াদ বৃদ্ধির হার ৯১.২৩ শতাংশ। সংশোধনের ধারা অব্যাহত রেখে আবার ব্যয় বাড়ানো হয় ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ব্যয় ২৫০.১৮ শতাংশ বাড়িয়ে হয় এক হাজার ৪৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। যেখানে কুয়েতি ঋণ এক হাজার ৭৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এবার মেয়াদ বাড়ে ১৬০ শতাংশ। মূল ডিপিপির তুলনায় দু’বার সংশোধন করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে এক হাজার ৩৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা মূল ব্যয়ের চেয়ে ২৫০.১৮ শতাংশ বেশি। আর সময় বাড়ানো হয়েছে ৬৬ মাস, যা অনুমোদিত মেয়াদের চেয়ে ১১৬ বেশি। গত ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত মূল সেতুর অগ্রগতি ৮১ শতাংশ এবং প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ। প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত করার কথা।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, একনেক থেকে ২০১২ সালের ৮ মে অনুমোদনের এক বছর তিন মাস পর প্রকল্পটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে। ডিসেম্বরে চুক্তি হলেও ২০ জানুয়ারি ২০১৪ সাল থেকে কাজ শুরু করে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ঠিকাদারের সাথে চুক্তি হয়। এটা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির দুই বছর পর। আর প্রকল্প অনুমোদনের তিন বছর আট মাস পর ভৌত কাজ শুরু করা হয়। প্রকল্পের মূল সেতুর টেস্ট পাইলের কাক্সিক্ষত ফলাফল না পাওয়ায় সেতুর ফাউন্ডেশনের ডিজাইনের পরিবর্তন করা হয়। ফলে মূল সেতুর ভিত্তির ডিজাইন পরিবর্তন, নদীর তীর রক্ষাপ্রদ কাজের ডিজাইন পরিবর্তন, সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির কারণে সর্বশেষ ডিপিপি সংশোধন করে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর দুই মাস বাড়ানো হয়।

আইএমইডির পর্যবেক্ষণ টিম সূত্র বলছে, সময় মতো ভূমি অধিগ্রহণ করতে না পারার কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে। প্রকল্পের এতটা সময় পার হওয়ার পর সেতু, তীর রক্ষাসহ ডিজাইন পরিবর্তন করাতে প্রকল্পটির কাজ অনেক পিছিয়ে গেছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা হলে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এখনো নদীর তীর রক্ষা ও টোল প্লাজার কাজ শুরু করা হয়নি। অথচ আট বছরের বেশি সময় ইতোমধ্যে অতিক্রম করেছে।

গত জানুয়ারিতে প্রকল্পটি পরিদর্শন করে এসে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী প্রকল্পটি সম্পর্কে বলছেন, প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে বিলম্ব, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নিয়োগে তিন বছর ৮ মাস বিলম্ব এবং মূল সেতুর ডিজাইন ও নদীতীর রক্ষাপ্রদ কাজের ডিজাইনে অতিরিক্ত ১৪ মাস সময় ব্যয় হওয়ায় বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। তিনি জানান, মূল ডিপিপির তুলনায় দু’বার সংশোধন করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে এক হাজার ৩৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা মূল ব্যয়ের চেয়ে ২৫০.১৮ শতাংশ বেশি। আর সময় বাড়ানো হয়েছে ৬৬ মাস, যা অনুমোদিত মেয়াদের চেয়ে ১১৬ বেশি। গত ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত মূল সেতুর অগ্রগতি ৮১ শতাংশ এবং প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/564593