২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:০৭

রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষা : একুশের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গ

বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা ও সীমাহীন আনন্দ উচ্ছ্বাসের মধ্যদিয়ে গত রোববার ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস পালিত হয়ে গেল। দিনটি সরকারি ছুটির দিন ছিল, এর সাথে শুক্র-শনি দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি যোগ হওয়ায় বহু মানুষ ছুটি উদযাপনের জন্য কর্মস্থল ছেড়ে দূর দূরান্তেও পাড়ি দিয়েছিলেন। বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী হাজার হাজার লোক সুদূর কক্সবাজারেও গিয়েছিলেন। অনেকে সেখানে হোটেল পাননি, খোলা আকাশের নিচে তাঁবু টাঙ্গিয়ে ঘুমিয়েছেন। আজ থেকে ঊনসত্তর বছর আগে ১৯৫২ সালের এই দিনে তৎকালীন পাকিস্তানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবিতে আহূত মিছিলে পুলিশের গুলীবর্ষণে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিয়ূর নামের পাঁচজন তরুণ শহীদ হয়েছিলেন। তাদের এই রক্তদান বৃথা যায়নি। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছিল।

বলাবাহুল্য, দীর্ঘ প্রায় পৌনে দুশ’ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালে বাংলা ভারত পাকিস্তান উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের দু’টি অংশ ছিল, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। তাদের একাংশ থেকে অপরাংশের দূরত্ব ছিল প্রায় এক হাজার মাইল। পাকিস্তানের পাঁচটা প্রদেশ ছিল; পূর্ব পাকিস্তান, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ছিল বাংলা, সিন্ধুর সিন্ধি, বেলুচিস্তানের বেলুচি, সীমান্ত প্রদেশের পুস্তু এবং পাঞ্জাবের পাঞ্জাবী। দেশ বিভাগের পর উর্দুকে উভয় পাকিস্তানের জনসাধারণের কমন ভাষা হিসেবে গণ্য করে তৎকালীন সরকার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। একইভাবে স্বাধীন ভারত বর্ষের বিভিন্ন এলাকায় তখন প্রায় ১০০টি ভাষা প্রচলিত ছিল। ভারত সরকার হিন্দিকে কমন ভাষা গণ্য করে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়। হিন্দি ভারতের কোন এলাার ভাষা ছিল না, ছিল কমন ভাষা, যেমন উর্দু পাকিস্তানের কোন এলাকার ভাষা ছিল না। বৃটিশ আমলে উভয় দেশের রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি; তার আগে মোগল আমলে অফিস আদালতের ভাষা ছিল ফারসি। নতুনভাবে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা ঘোষিত হওয়ায় ভারতের কোন অঞ্চল থেকেই প্রতিবাদ উঠেনি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি উঠে। এখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের জন্য দাবি উঠে। এই দাবির অগ্রভাগে ছিল তমদ্দুন মজলিশ নামক একটি ধর্মীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার প্রধান ছিলেন অধ্যক্ষ আবুল কাশেম। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ প্রদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালীন ডাকসুর জিএস গোলাম আযম (পরবর্তীকালে অধ্যাপক গোলাম আযম) এই আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঢাকা সফরের প্রাক্কালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসম্পন্ন মানপত্র পাঠ করেছিলেন। তারও চার বছর পর ’৫২ সালের ৮ ফাল্গুন মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি একই দাবিতে আহূত মিছিলে পুলিশের গুলীতে ৫টি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে এবং এই জুলুমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভ ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের বিক্ষোভ। এরপর পদ্মা মেঘনা যমুনার পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্ষোভ প্রথমে স্বায়ত্তশাসন ও পরে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আশা ছিল জুলুম বন্ধ করে মানুষ তার গণতান্ত্রিক অধিকারসহ মৌলিক মানবিক অধিকার ফিরে পাবে কিন্তু তা কি তারা পেয়েছে? ’৬৯ বছর পর তার মূল্যায়ন হওয়া দরকার।

ইতোমধ্যে ভাষা আন্দোলনের কৃতিত্ব হাইজ্যাক হয়ে তৌহিদপন্থীদের হাত থেকে এথিস্ট-সেকুলারিস্টদের হাতে চলে গেছে। ডাকসুর ইতিহাস থেকে গোলাম আযমের নাম মুছে ফেলা হয়েছে। সেখানে যে ফলক তৈরি হয়েছে তাতে গোলাম আযমের পিরিয়ডটি খালি। তমদ্দুন মজলিস ও অধ্যক্ষ আবুল কাশেমকে ইতিহাস থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। ভাষার পদক এদের পাওনা ছিল। সরকারের পা চাটতে পারলে যে কেউ এখন তা পায়।

বায়ান্ন সালে আমি প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। শ্রেণী শিক্ষকের পরিচালনায় রাস্তায় রাস্তায় প্লেকার্ড ও ফেস্টুন হাতে মিছিল করার স্মৃতি এখনো আমার মনে পড়ে। মিছিলের শ্লোগান ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিনের গর্দান চাই।’ নূরুল আমিন তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পুলিশের গুলীতে ছাত্র মৃত্যুর প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ নয় একেবারে গর্দান চাওয়া হয়েছিল। এখন কি এভাবে গর্দান চাওয়া যাবে? মিছিল শেষে শ্রেণী শিক্ষকের নেতৃত্বে ভাষা শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় আমরা মুনাজাত করেছিলাম।

ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তারা সবাই মুসলমান ছিলেন। মুসলমান মারা গেলে তার বা তাদের রূহের মাগফেরাত চেয়ে দোয়া করা অন্য মুসলমানদের দায়িত্ব। আজ এই দায়িত্ব কি আমরা পালন করছি। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণ করে রাজধানীসহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উল্লেখযোগ্য স্থানসমূহের তৈরি শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। ফুল দিয়েরতাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। তাদের জন্য দোয়া করা হয়েছে এই সংবাদ আমি কোথাও শুনিনি। গান-বাজনা, আবৃত্তি, গীতিনাট্য, অভিনয় প্রভৃতিই এখানে মুখ্য। দোয়া অনুষ্ঠানের অনুপস্থিতিতে ফুলের স্তবক দিয়ে ঢাকা মিনার চত্বরকে অনেকে পূজামণ্ডপ বলেও ভুল করেন। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে শহীদদের প্রতি এটা শ্রদ্ধা না অবজ্ঞা সরকার আলেম সমাজের সাথে পরামর্শ করে তা ঠিক করে নিতে পারেন।
আন্দোলনের পর বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের এই স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালে আমরা স্বধীনতা অর্জন করি। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম দিন থেকেই বাংলা রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সকল অফিসের ভাষা হিসেবে ১৯৮৫ সাল পর্যন্তই ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে জেনারেল এরশাদের আমলে সরকারী অফিসের নোটশিট ও চিঠিপত্র বাংলায় করার আদেশ জারি হয়। বর্তমানে উচ্চ আদালতের বেশির ভাগ রায় ছাড়া আর সব ক্ষেত্রেই বাংলা চালু হয়ে গেছে।

অবশ্য সর্বত্র বাংলা চালু করতে গিয়ে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীও আন্তর্জাতিক ভাবসমূহ বিশেষ করে আরবী ও ইংরেজির ক্ষেত্রে বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছি। কিছু কিছু দাতাসংস্থা অভিযোগ করেছেন যে সচিবালয়ের অনেক সচিব ইংরেজিতে যোগাযোগে অক্ষম। একটা কথা সম্ভবত আমরা ভুলে গেছি। যে বাংলা আমাদের রাষ্ট্র ভাষা সেই বাংলা কি আমাদের মাতৃভাষা? আমি বলব না। আমরা যে অঞ্চল বা জেলার বাসিন্দা সেই অঞ্চল বা জেলার ভাষাই আমার মাতৃভাষা। এই দৃষ্টিকোন থেকে নোয়াখলি, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহীসহ বাংলাদেশের সবগুলো জেলার ভাষাতে স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। এর মধ্যে আবার মিলও রয়েছে। আমার মনে আছে নব্বই-এর দশক পর্যন্ত আমি কয়েকটি জেলা, বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রামে পাবলিক অনুষ্ঠানে গেলে স্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে যেতাম অথবা তাদের সহায়তা নিতাম। কেন না স্থানীয় বাসিন্দাদের কথা আমি বুঝতাম না, তারা আমার কথা বুঝতেন না, তারা বলতেন আমি কেন ইংরেজি বলছি। অথচ আমি শুদ্ধ বাংলাতেই কথা বলতাম।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার অর্থ আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষাসমূহকে উপেক্ষা করা নয়। আমরা কিন্তু এই উপেক্ষার দিকেই গেছি বেশি, এই উপেক্ষা থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে উপহাসেরও সৃষ্টি হচ্ছে। হাসি-তামাশার জন্য অধুনা আঞ্চলিক ভাষাসমূহকে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবণতা রোধ করা দরকার। আঞ্চলিক ভাষা হাসির বিষয় বস্তু হতে পারে না।

আমাদের আঞ্চলিক ভাষাসমূহের সমৃদ্ধ শব্দ ভাণ্ডার রয়েছে। এগুলোর সংরক্ষণ সম্প্রসারণ ও বিকাশ সাধন দরকার। বাংলা একাডেমি নামে আমদের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এক সময় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড নামে আরো একটি প্রতিষ্ঠান ছিল, এখন নজরে পড়ে না। বাংলার আঞ্চলিক তথা মাতৃভাষাসমূহের উপর এদের গবেষণা করার দরকার।

অব্যাহত গবেষণা ও মূল্যাায়ন এই ভাষাগুলোকে আরো সমৃদ্ধ করবে এবং সামগ্রিক উৎকর্ষ সাধনে সহায়তা করবে। বাংলার বিকাশ অপরাপর ভাষাসমূহের বুৎপত্তি সাধনে আমাদের সহায়তা করুক এই কমনাই করছি। আমি সকল ভাষা শহীদ, ভাষা আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ অধ্যাপক গোলাম আজম ও আবুল কাশেমসহ সকলের রূহের মাগফেরাত কামনা করি।

https://dailysangram.com/post/444688