২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১২:২৬

প্রতি বছরই নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ

তবু বেসামালই থাকে রোজার বাজার

কঠোর মনিটরিং করে ব্যবস্থা নিতে হবে -গোলাম রহমান - তদারকি চলছে, এবার কাউকে ছাড় নয় -মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার

প্রতি বছর রমজান এলেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এমনকি কিছু পণ্যের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন ওপেতে থাকেন এ মাসের জন্য। প্রশাসনও নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভা-বৈঠক। কঠোর হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়। ব্যবসায়ীরাও পণ্যের দাম না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব পদক্ষেপ-প্রতিশ্রুতি থেকে যায় কাগজে-কলমে। বাস্তবে কার্যকর হয় না। নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না রোজার বাজার।

গত কয়েক বছরে রোজার বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার মনিটরিং ব্যবস্থা চালু, ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের অভিযান, টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি এবং ভ্যাটসংক্রান্ত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এরপরও বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না। যথারীতি পণ্যের দাম বেড়েই চলে। সর্বশেষ গত বছর রমজানে সরকারের পক্ষ থেকে দাম বাড়বে না- এমন প্রতিশ্রুতির পরও প্রতি কেজি ছোলা ৫-৮ টাকা, মসুর ডাল ২০-২৫ টাকা, পেঁয়াজ ১০-১৫ টাকা, চিনি, ৫-৬ টাকা, গরুর মাংস ৫০-১০০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ফল ও সবজি বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাজার ব্যবস্থায় বর্তমানে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আর রমজান এলেই এ প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই রমজান আসার আগেই এ বিষয়টি নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া ভোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, রমজান ঘিরে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। ১৫ দিনের পণ্য একদিনে কেনা যাবে না। এতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে ব্যবসায়ীরাও সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দেয়।

জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, রমজান উপলক্ষে আগেভাগে অধিদফতরের পক্ষ থেকে বাজার তদারকি শুরু হয়েছে। পাশাপাশি রুটিন মাফিক তদারকি চলছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে কোন পণ্য কী দামে কেনা ও বিক্রি তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া অধিদফতরের টিমের সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের তদারকি সদস্যরা কাজ করছে। পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও কাজ করছে। কোনো ধরনের অনিয়ম পেলেই কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। দরকার হলে প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হবে। এছাড়া জরিমানাসহ জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। এবার অসাধুদের কোনোভাবে ছাড় দেয়া হবে না।

আগামী ১৪ এপ্রিল রোজা শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজার বেসামাল হতে শুরু করেছে। তাই ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে দাম বেঁধে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে এক বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, এবার শক্ত হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামতেলের আমদানিতে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় ভ্যাট হার আরও বেশি যৌক্তিকহারে নির্ধারণের জন্য ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ করা হয়েছে।

প্রতি বছরই রোজার আগে এ ধরনের বৈঠক হয়। ওইসব বৈঠকে উপস্থিত থাকেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিএফটিআই, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড টেরিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ব্যবসায়ী গ্রুপসহ সরকারের একাধিক আইনশৃঙ্খলা এজেন্সি।

গত বছর রমজানের আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে সরকারের নজর রয়েছে। যখন যা প্রয়োজন তাই করা হবে। অসাধু পন্থা নিলে শাস্তির আওতায় আনা হবে। ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ রোজার বাজার নিয়ে বৈঠক হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। ওই বৈঠকে পণ্যের দাম বাড়ানো হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের প্রতি আস্থা রেখে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না। সিন্ডিকেটেরও সুযোগ নেই। একইভাবে ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল রমজানের পণ্যমূল্য সাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন ওই সময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। পরে তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, এবার রমজান ঘিরে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। তাই দাম বাড়বে না। এছাড়া দাম নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়ার কথাও বলেন তিনি। কিন্তু কোনো বছরই রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। প্রতিবারই বাড়তি দামের অভিযোগ ওঠে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর মৌলভীবাজারের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক যুগান্তরকে বলেন, সরকার সব সময় রমজান এলেই ভোক্তার স্বার্থ চিন্তা করে অনেক ধরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রমজানে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে- আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশের বাইরে থেকে পণ্য চাহিদামতো আমদানি করি। বেশি দামে আমদানি করলে বেশি দরে বিক্রি করতে হয়। রমজানের শুরুতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক হলেও আমদানি পর্যায়ের দামের দিকে নজর দেয়া হয় না। এছাড়া দেশে রমজাননির্ভর পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও এসময় ভোক্তা বাড়তি পণ্য কেনে। এতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে দাম বেড়ে যায়। আবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মোকাম থেকে পণ্য আনার সময় মহাসড়কে নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠন চাঁদা তোলে। যার ফলে পণ্য সরবরাহ খরচ বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে পণ্যের দামে। প্রতি বছরই ঘুরেফিরে একই চিত্র থাকে।

তিনি বলেন, তবে ব্যবসায়ীরাও যে সিন্ডিকেট করেন না তাও বলা যাবে না। একটু লাভের আশায় মোকাম থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কারসাজিও করা হয়। তাই সব বিষয় সামনে রেখে তদারকি জোরদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকার সংশ্লিষ্টদের বৈঠকের মাধ্যমে সামাধানের পথ খুঁজতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/394904