২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১২:২১

বাংলা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা

আমরা বাংলা লেখি। বাংলা কথা বলি। বাংলা গান গাই। বাংলা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা। এ ভাষার জন্য বাংলার দামাল ছেলেরা অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছেন নির্ভয়ে এবং অসীম সাহসিকতায়। ফলে বাংলা এ দেশের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা অর্জন করেছে। মর্মান্তিক এবং এমন ঐতিহাসিক মর্যাদার ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এ দিনটি এখন মাতৃভাষা এবং আন্তর্জাতিক ভাষাদিবস হিসেবে স্বীকৃত।

প্রতিবছর এ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি আসে। যায়ও। বাংলাভাষা নিয়ে অনেক কথকতা হয়। আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন থাকে। নামি-দামি ব্যক্তির বক্তৃতা হয়। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে মাসব্যাপী একটা বইমেলা চলে ঘটা করে। শত শত নতুন বই বেরোয় বইমেলা উপলক্ষে। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি এসব বিষয় থাকে নতুন বইয়ের। অনেক লেখকের মন এবং মননশীলতারও পরিচয় থাকে এসব বইয়ে। যদিও করোনার দাপটে এবার বইমেলা পিছিয়ে মার্চে অনুষ্ঠিত হবার কথা। বাংলাভাষা নিয়ে অনেক কথা হয়। আয়োজন চলে। আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাংলাভাষার তেমন উন্নতি হয় বলে মনে হয় না। বরং বাংলাভাষা আরও বিশৃঙ্খল ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। যে-যার ইচ্ছেমতো বাংলাভাষার ব্যবহার করছেন। এতে যে আমাদের প্রাণের ভাষার শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে তা নির্দ্বিধায় বলা চলে।

ফেব্রুয়ারি না ফাল্গুন এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস হিসেবে স্বীকৃতির পর সে বিতর্ক বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। বাংলাভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বাংলা মাস ফাল্গুনের একটা গভীর সম্পর্ক থাকলেও তা ইংরেজি ফেব্রুয়ারির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। তাই এনিয়ে আর কোনও বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ নেই বলেই মনে হয়।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। অবশ্য পিতৃভাষাও। ভগ্নি এবং ভাতৃভাষাও। এ ভাষা কেবল মায়ের কাছ থেকেই শেখা হয় না। পিতা বা বাবার কাছ থেকেও শেখা হয়। এমনকি বোন এবং ভাইয়ের কাছ থেকেও মানুষ ভাষা শেখে। বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও তাই। শুধু মায়ের কাছ থেকেই আমরা ভাষা শিখি না। পিতা, ভাই, বোনের কাছেও আমরা ভাষা শিখে থাকি। তাই বাংলা আমাদের শুধু মাতৃভাষাই নয়, পারিবারিক ভাষাও বটে।

দু’বছর আগে ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে দৈনিক পত্রিকারগুলোর সঙ্গে দেয়া একটি লিফলেট হাতে পাই। শিরোনাম ছিল ‘পড়াতে চাই’। এটির নিচে তিনজনের নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর লেখা ছিল। তিনজনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এদের একজন পদার্থবিজ্ঞানের মাস্টার্স। একজন গণিতের। অন্যজন শুধু মাস্টার্স। কী বিষয় তার উল্লেখ নেই। যিনি পদার্থবিজ্ঞানের তিনি ডিগ্রিটা লেখেছেন “এম.এস.সি (পদার্থ বিজ্ঞান)”, যিনি গণিতের তিনি লেখেছেন “এম,এস,সি (গণিত)”। আর যিনি বিষয় উল্লেখ করেননি, তিনি লেখেছেন এম,এ।

পদার্থবিজ্ঞানের জন ডিগ্রিটা লেখেছেন দুটো ফুলস্টপ দিয়ে। গণিতের জন ডিগ্রি লেখেছেন দুটো কমা দিয়ে। আর নরমাল মাস্টার্সের জন লেখেছেন একটা কমা দিয়ে। অর্থাৎ তিনজনই অর্জিত ডিগ্রি লেখতে ভুল করেছেন। আর পদার্থবিজ্ঞানের জন বিষয় লেখতে মাঝখানে ফাঁক রেখে দিয়েছেন। এটা যে একরকমের ফাঁকিবাজি তা হয়তো তিনি বুঝতে পারেননি। কারুর কাছে জেনেও নেননি।

লিফলেটে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, বাসায় গিয়ে অতিযত্নসহকারে প্রাইভেট পড়াতে চান। প্রশ্ন হচ্ছে, বিজ্ঞাপনদাতারা নিজেরাই যত্নসহ পড়ালেখা করেননি বা শেখেননি। এতো তাঁদের ভুলেভরা লিফলেটই প্রমাণ করছে। তাহলে অন্যদের ‘অতিযত্নসহ’ কীভাবে পড়াবেন?

হ্যাঁ, ‘পড়াতে চাই’ শীর্ষক বিজ্ঞাপনদাতারাই কেবল ভুল করেন এমন নয়। আরও অনেকই ভুল করেন। তবে সাধারণ মানুষের ভুল আর শিক্ষিত লোকের ভুল এক নয়। বিশেষত যারা শিক্ষক বা ছাত্র পড়ান তাঁদের এমন ভুল হওয়া অনুচিত। নিজে ভালো করে না শিখে অন্যকে শেখাতে যাওয়া অপরাধ। অন্যায়। একরকম দুষ্কর্ম। তবে আজকাল অনেকই বাধ্য হয়ে বা অন্য উপায় না পেয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এখানেই সমস্যা হয় বেশি। ভাষা নিয়ে গোল বাঁধে। শিক্ষক হতে মন সায় দেয় না। আগ্রহ নেই শিক্ষকতা পেশায়। অথচ শিক্ষক হতে যান বেকায়দায় পড়ে। তখনই ভুল হয়। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ। গোল হওয়াই তো স্বাভাবিক। জোর করে যেমন শিক্ষক হওয়া উচিত নয়; তেমনই ভালোভাবে না শিখে অন্যকে শেখাবার চেষ্টাও এক ধরণের প্রতারণা। ফাঁকিবাজি।

একসময় ঢাবি'র এক প্রফেসর আমাদের অফিসে আসতেন তাঁর লেখা নিয়ে। পরে তিনি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হন। কয়েকটি বিরাটকায় বইও লেখেছেন। একদিন তাঁর একটা এমন বই আমার হাতে পড়ে। ওতে লেখকের নামের সঙ্গে লেখা আছে ‘পি.এইচ.ডি’ এভাবে। একদিন ভদ্রলোককে কাছে পেয়ে শক্ত করে ধরলাম। বললাম, এটা কী ডিগ্রি এবং কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া? প্রথমে উল্টো প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে?’ এরপর বুঝিয়ে বললে দোষটা যথারীতি ছাপাখানার ওপর চাপাতে চাইলেন। আমি প্রফেসরের মুখের ওপর বেশ কড়া ভাষায় বলে দিলাম, নিজের অজ্ঞতাজনিত ভুলটা অন্যের ঘাড়ে চাপানোর অভ্যাসটা শুধরে নেয়া উচিত। এরপর ডক্টর অব ফিলোজফি ডিগ্রিটা কীভাবে লেখা হয় তা দেখালাম। হ্যাঁ, ওটা লেখতে হয় ‘পিএইচ.ডি.’ অথবা ‘পি-এইচ.ডি.’ এভাবে। অর্থাৎ গৃহশিক্ষক হবার আগ্রহীরা যেভুল করেছেন, এ প্রফেসরও একই ভুল করেছেন ডিগ্রি লেখতে। এমন ভুল আরও অনেকেই করেন। তবে ভুলটা স্বীকার করতে চান না।

আজকাল ঝামেলা এড়াতে অনেকেই ‘পিএইচডি’ এভাবে লেখেন। যারা শুদ্ধ করে লেখতে পারেন না, তাঁদের জন্য এটা সহজ পদ্ধতি। মনে রাখতে না পারলে কী করবেন?

আমরা বিদেশি ভাষা যত্নসহকারে শিখি। কিন্তু নিজের ভাষা শেখবার ব্যাপারে মনোযোগী হই না। মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করি। ‘যেনতেনপ্রকারে’ সেরে ফেলবার চেষ্টা করি। এটা খুবই দুঃখজনক। লজ্জাকরও। বাংলা মাতৃভাষা বলে অনেকেই অবহেলা করি। উপেক্ষা করি। কিন্তু না, মাতৃভাষা হলেও বাংলার অনেক কিছু শেখবার আছে। ভালোভাবে না শেখলে, না জানলে বলতে এবং লেখতে গিয়ে নানা ভুলভ্রান্তি হবে। হওয়াটাই স্বাভাবিক।

যারা মাতৃভাষা শুদ্ধ করে লেখতে বা বলতে পারেন না, তাঁরা অন্য ভাষাও ভালো করে শেখতে পারেন বলে মনে হয় না।
নিজের ভাষা ভালো না জানলে অন্য ভাষাও ভালো করে জানা বা শেখা যায় না। এটা চিরন্তন সত্য।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বিদেশি ভাষা তথা ইংরেজির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। ফলে বাংলা হয় উপেক্ষিত। এতে বাংলা যেমন শেখা হয় না ভালো করে; তেমনই ইংরেজিও শেখা হয় না। তাই ইংরেজি ভালোভাবে শেখতে বা জানতে হলেও সবার আগে মাতৃভাষা বাংলা শেখা জরুরি। এটা অন্তত বাংলাভাষীদের করতে হবেই। কারণ নিজের ভাষা উপেক্ষা করে অন্য ভাষা ভালোভাবে শেখবার দাবি পুরোপুরি ভণ্ডামো। নষ্টামো।

বাংলাভাষা ভুলভাবে উপস্থাপনে শিশুদের ওপর বাজে প্রভাব পড়ে। পাঠ্যবইয়ে ভুল। স্কুলের স্যার পড়ান ভুল। গৃহশিক্ষক শেখান একরকম। একেক পত্রিকার বানানরীতি একেক রকম। আবার টিভি'র স্ক্রলে বাংলা বানান দেখা যায় অন্যরকম। কোনটা সঠিক তা বুঝে ওঠা শিশুকিশোর শিক্ষার্থীদের জন্য সত্যিই মুশকিল।
সড়ক-মহাসড়কের পাশে বিভিন্ন দোকান-পাট, অফিস-আদালতের সাইনবোর্ডে বাংলা বানানের যে বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতা তা হতভম্ব হবার মতো। এসব দেখে হাসবো না কাঁদবো তা ঠাওর করা বড় কঠিন।

বাঙালি জাতি হিসেবে গৌরব করবার মতো যেসব বিষয় আছে তার মধ্যে আমাদের বাংলাভাষা অন্যতম। এ ভাষার মর্যাদা ও সম্মান মানে বাঙালি জাতির মর্যাদা এবং সম্মান। বাংলাভাষার গৌরব তথা আমাদেরই গৌরব বা অহঙ্কার। এ অহঙ্কার নেতিবাচক কিছু নয়। এ অহঙ্কার আমাদের বেঁচে থাকবার অঙ্গীকার। মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে টিকে থাকবার দৃঢ়প্রত্যয়।

বাংলাভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখবার দায়িত্ব আমাদের সকলের। তবে যারা শিক্ষক অর্থাৎ স্কুল-কলেজে, মাদরাসায় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান তাঁদের দায়িত্ব বেশি। বাংলাভাষা শিক্ষকদের যেমন যত্নসহকারে শেখতে হবে, তেমনই তা অন্যদের শেখাতে তথা অভিনিবেশসহকারে পাঠদানও করতে হবে। শিক্ষকরা নিজেরাই অভিনিবেশের সঙ্গে বাংলাভাষা না শেখলে শিক্ষার্থীদের তা কীভাবে শেখাবেন?

খুব উঁচু মাপের একজন শিক্ষক ছিলেন আমার। নামটা এখানে উল্লেখ করলাম না। তাঁর তিনখণ্ডের বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসগ্রন্থে ‘ঐকমত্য’ শব্দটা ভুলভাবে ছাপা হয়েছিল ‘ঐক্যমত'। মানে ভুলটা স্যারই করেছিলেন। আমি এ ব্যাপারে একদিন স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তিনি নিজের ভুল স্বীকার করে নেন তাৎক্ষণিকভাবে। বলে নেয়া ভালো, কারুর কোনও ভুল হলে তা শুধরে নেয়া মহত্বের লক্ষণ। স্যার কেবল ভুলটা স্বীকারই করলেন না। সেদিন থেকে তিনি অনেকের কাছেই আমাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন। এ হচ্ছে মহৎ মানুষের মহত্ব, বড়ত্ব এবং মহানুভবতা। অথচ আজকাল অনেক চুনোপুঁটি ভাষার ‘ভ’ শেখেননি। কিন্তু অহঙ্কারে তাঁদের পা মাটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে চায় না। উল্লেখ্য, আমাদের বেশ চেনাজানা একজন জাঁদরেল সাংবাদিক আছেন। তিনিও ভুল বানানে শব্দটা ‘ঐক্যমত’ লেখেন। শুধু তাই নয়, নিজের নামের শেষাংশও ভুল বা বিকৃতভাবে লেখেন। এতে যে শিশুকিশোর শিক্ষার্থীদের কাছে দীর্ঘমেয়াদি ভুল বা বিভ্রান্তিকর বার্তা পৌঁছায় তাও অনেকে মানতে চান না। এটা দুশ্চিন্তার কারণ অবশ্যই। যারা বড় এবং দায়িত্বশীল তাঁদের আরও বড়ত্ব ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। কারণ অনেকে তাঁদের অনুসরণ করেন। আদর্শ ভাবেন। মানুষের ভুল হয়ই। তবে সে-ভুল শুধরে নেবার সৎসাহস থাকা জরুরি। অন্যথায় অমনুষ্যত্বই জিতে যায়। মূর্খতা আশকারা পায়। যা কারুর কাম্য হতে পারে না।

কয়েক দিন আগে ভাষার মাস এ ফেব্রুয়ারিতে করোনার টিকা নিতে আগ্রহীদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে “স্ব-শরীরে” টিকাদান কেন্দ্রে উপস্থিত থাকতে। উল্লেখ্য, “স্ব-শরীর” এর “ব-ফলা”টা যে অযাচিত বা বাহুল্য তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা জ্ঞাত নন।

https://dailysangram.com/post/444374