১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৭

সময় বাড়ছে তার ঝুলছে

মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণ, অক্টোবর পর্যন্ত উত্তর বাড়িয়েছে সময় ৩১ মার্চের পর ফের দক্ষিণের মূল সড়কে চলবে তার কাটা পার্শ্ব সড়কে অভিযান অব্যাহত

রাজধানীর সড়কগুলোতে হাটলে এক বিরল দৃশ্য চোখে পড়ে। মূল সড়ক কিংবা গলি পথ প্রতিটিতেই বিদ্যুতের পিলারের সাথে সাথে ঝুলছে তারের জঞ্জাল। যা পৃথিবীর অন্যকোন দেশে কাল্পনিক। ইন্টারনেট, ক্যাবল অপারেটর, বিদ্যুতের তারসহ কত রকম তার যে সড়কের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে তা বোঝা মুসকিল। অথচ ঝুলন্ত তার ও বিদ্যুতের লাইন ভূ-গর্ভে নিয়ে দেশের প্রথম তারবিহীন শহরে নাম লিখিয়েছে সিলেট। ওই শহরের তারবিহীন সড়কে হাঁটলে অনেকেই হয়তো ভুলে যাবেন তিনি বাংলাদেশ নাকি অন্য কোন দেশের সড়কে হাঁটছেন। জঞ্জাল সরালে সড়কের সৌন্দর্য কিভাবে বেড়ে যায় তা বিদেশ নয়, সিলেটের সড়কই দেখিয়েছে।

রাজধানীতে তার অপসারণ করতে যে উদ্যোগ নেয়া হয়নি তা কিন্তু নয়, ১৩ বছর আগে ঝুলন্ত তার অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি ভূ-গর্ভস্থ কমন নেটওয়ার্ক করতে লাইসেন্স দেয় ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন্স ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের (এনটিটিএন)। কিন্তু যাদের তার ঝুলছে সেই ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি) ও ক্যাবল অপারেটরদের (ডিস সংযোগ প্রদানকারী) অনিহা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে হুমকী ধামকী দিয়ে ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে ঝুলিয়ে রাখছে তার।

দিনের পর দিন সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনার নির্দেশনা দিলেও কোন কিছুকেই পাত্তা দেয় না ইন্টারনেট ও ক্যাবল সংযোগ ব্যবসায়ীরা। অনেক ক্ষেত্রে সরকারও তাদের কাছে অসহায়। যখনই কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তাদের অনিয়ম, অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে তখনই তারা শুরু করেন হুমকী-ধামকী দেয়া। গ্রাহকদের জিম্মি করে আদায় করেন অনৈতিক দাবিও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কের উপর দিয়ে তার ঝুলিয়ে সেবা দিতে আইএসপি ও কোয়াবের কোন খরচ হচ্ছে না। কিন্তু এনটিটিএনগুলোর কাছ থেকে সেবা নিতে হলে তাদেরকে ফি দিতে হবে এজন্যই তাদের এই অনিহা।

রাজধানীর সড়কগুলোর সৌন্দর্য বাড়াতে এবং ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল সরাতে চায় উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও ক্যাবল অপারেটরদের (কোয়াব) অসহযোগিতার কারণে সফল হচ্ছে না এই উদ্যোগ। বিগত ১২ বছরের বার বার সময় দেয়ার পর গত ৫ মাসে তিন দফা সময় নিয়েছে এই দুটি সংগঠন। কিন্তু কোন আল্টিমেটামেই কাজ হচ্ছে না। নামমাত্র কয়েকটি সড়কে চলছে তার অপসারণের কাজ। ফলে ফের তার কাটছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। আর উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) তার অপসারণ করতে সময় দিয়েছে অক্টোবর পর্যন্ত।

তার অপসারণে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি ও বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যর্থতার পর গত আগস্টে দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস জঞ্জাল সরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার নির্দেশে দক্ষিণ সিটি রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তার কেটে অপসারণও করে। কিন্তু ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও ক্যাবল অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) এর সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধের হুমকীতে থমকে যায় সেই অভিযান।

পূর্ব নির্দেশনা না দেয়া এবং বিকল্প ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগ এনে ১৮ অক্টোবর থেকে সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দেয় আইএসপি ও কোয়াব। পরবর্তীতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক আইএসপিবি ও কোয়াবের সাথে বৈঠকে আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসূচি স্থগিত করেন তাঁরা। এরপর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করে মাটির নিচ দিয়ে তার নেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয় এবং কর্মসূচি তুলে নেয় আইএসপিএবি। নভেম্বরের মধ্যেই তার মাটির নিচে নিতে আল্টিমেটাম দেয় দক্ষিণ সিটি। সেই সময়েও কাজ না হওয়ায় আবারও এক মাস সময় বাড়িয়ে দিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ফের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেই সময় বাড়ানো হয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় দিয়েছে দক্ষিণ সিটি। এর মধ্যে নিজ উদ্যোগে মূল সড়কের তার অপসারণ করে মাটির নিচ দিয়ে না নিলে ঝুলে থাকা তার কেটে ফেলবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আর পার্শ্ব সড়কের তার অপসারণের সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন সড়কে এখন তার কাটছে ডিএসসিসি। অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশন তার অপসারণ করতে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত আইএসপিএবি ও কোয়াবকে সময় দিয়েছে। এর মধ্যে অপসারণ করা না হলে তারাও অভিযান শুরু করার কথা জানিয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত দক্ষিণ সিটিতে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড সংলগ্ন আশপাশের এলাকায় মাটির নিচে তার স্থাপনের কাজ শুরু করেছে আইএসপিএবি। অন্যদিকে উত্তর সিটিতে গুলশান এভিনিউ ও উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের তিনটি সড়কে মাটির নিচ দিয়ে সংযোগ নেয়ার কাজ শেষ হয়েছে। এর বাইরে উত্তরা ৪, ৬ ও ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন সড়কে এবং গুলশানের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এলাকা থেকে বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে কাজ চলছে। এর বাইরে পুরো ঢাকা শহরের সড়কেই ঝুঁলছে তারের জঞ্জাল।

জানতে চাইলে আইএসপিএবি’র সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আমাদেরকে মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দিয়েছে আর উত্তর দিয়েছে অক্টোবর পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে তার অপসারণ করা সম্ভব হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দক্ষিণের মূল সড়কে ৫০-৬০ ভাগ কাজ করা সম্ভব হবে। আবার যেসব সড়কে মেট্রোরেলের কাজ চলছে সেসব সড়কে কাজ করা যাচ্ছে না। এপ্রিল পর্যন্ত হলে হয়তো ৮০ ভাগ তার মাটির নিচ দিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। বার বার সময় বাড়িয়ে দেয়ার পরও কেন বিলম্ব হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে এমদাদুল হক বলেন, ২০ বছরের তারের জঞ্জাল চাইলেই ২ মাস, ৬ মাসে অপসারণ করা সম্ভব নয়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, মার্চ পর্যন্ত আমাদের সময় দেয়া হয়েছে কিন্তু দক্ষিণে বিভিন্ন সড়কে তার কেটে ফেলা হচ্ছে। এতে গ্রাহক ভোগান্তির পাশাপাশি আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

তিনি জানান, দক্ষিণ সিটিতে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ধানমন্ডিতে একটি সড়কের তার অপসারণ করে মাটির নিচ দিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া উত্তর সিটিতে আমেরিকান এ্যাম্বাসি থেকে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ পর্যন্ত এবং পাকিস্তান এ্যাম্বাসি থেকে শ্যুটিং ক্লাব পর্যন্তও তার মাটির নিচে নেয়া হয়েছে। তবে পুরো ঢাকা শহরের সড়ক থেকে তার অপসারণ এতো অল্প সময়ে নেয়া সম্ভব না।

জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র মো. আবু নাছের বলেন, আইএসপি ও কোয়াবের অনুরোধে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস তাদেরকে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তার মাটির নিচ দিয়ে নিতে পারেনি। সর্বশেষ ৩১ মার্চ পর্যন্ত মূল সড়কের তার অপসারণ করার জন্য সময় দেয়া হয়েছে। আর পার্শ্ব রাস্তার তার অপসারণের সময়সীমা আগেই শেষ হয়ে গেছে আগেই। তাই এখন সেসব তার কেটে অপসারণ করছে দক্ষিণ সিটি। ৩১ মার্চের পর মূল সড়কে তার ঝুললে সেগুলোও কেটে অপসারণ করা হবে।

আবু নাছের বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সড়ক থেকে জঞ্জাল সরাতে অনঢ় অবস্থানে।

https://www.dailyinqilab.com/article/358887