১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৩

ফেনীতে বাখরাবাদ মানেই লুটপাট

৬ বছরে ১৩ কোটি টাকার গ্যাস চুরি

ফেনীতে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। জেলাজুড়ে যত্রতত্র অনুমোদনহীন সংযোগ, ভুয়া বিল বই তৈরি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল আদায় এমনকি হাজার হাজার ফুট লাইন বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। বাখরাবাদের গুটিকয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে গড়ে ওঠা ওই চক্র দিবারাত্রি অবৈধ সংযোগ দিয়ে থাকেন। শুধু শহরের একটি অবৈধ লাইনের মাধ্যমে গত ছয় বছরে ১৩ কোটি টাকার বেশি গ্যাস চুরি হয়েছে। গতকাল বুধবার বাখরাবাদের সমন্বয়ে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, র্যাবের বিশেষ অভিযানে অবৈধ লাইনটি উচ্ছেদ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে ফেনী পৌরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ড রামপুরে মহাসড়কের র্যাব ক্যাম্প সম্মুখস্থ স্থান থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকায় অবৈধ গ্যাস লাইন স্থাপন করেন তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনির আহাম্মেদ। ওই এলাকায় ১৪৩টি রাইজার স্থাপন করে ৬-৭ হাজার গ্রাহক থেকে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। গতকাল বুধবার অবৈধ গ্যাস লাইন উচ্ছেদে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও সহকারী কমিশনার এন এম আবদুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আজগর আলী, বাখরাবাদের নোয়াখালী অঞ্চলের ডিজিএম সগির আহম্মদ ও মো: সোলায়মান, ফেনী এরিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো: সাহাবুদ্দীন, শহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক সুদীপ রায়, ফেনী মডেল থানার ওসি (তদন্ত) ওমর হায়দার প্রমুখ অংশ নেন।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, বিপুলসংখ্যক র্যাব ও পুলিশ সদস্যদের নিয়ে পৌরসভার রামপুর এলাকায় অবৈধ গ্যাস লাইন উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই এলাকায় অবৈধ স্থাপনার মধ্যে ৭০ শতাংশ পরিমাণ প্রায় ৭ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস লাইন তুলে নেয়া হয়েছে।

বাখরাবাদের ডিজিএম সগির আহম্মদ জানান, ২০০ চুলার সংযোগ থেকে প্রতি মাসে বাখরাবাদের ১৮ লাখ টাকার গ্যাস চুরি করেছে। দীর্ঘ দিন ধরে এ লাইন উচ্ছেদের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। গতকালের অভিযানে ৯ হাজার ৫২০ ফুট অবৈধ গ্যাস লাইন উচ্ছেদ ও ৪২টি রেগুলেটর জব্দ করা হয়।

বাখরাবাদের ফেনী এরিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো: সাহাবুদ্দীন জানান, পশ্চিম রামপুরে অবৈধ গ্যাস লাইন সংযোগের ঘটনায় ২০১৮ সালের ১২ মার্চ বাখরাবাদের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলার বাদি তৎকালীন এরিয়া ব্যবস্থাপক আবু সাঈদ সরকার। একমাত্র আসামী সাবেক পৌর কাউন্সিলর মনির আহম্মদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।

এর আগে ২০১৮ সালের ১২ মার্চ ওই এলাকায় অবৈধ গ্যাস লাইন উচ্ছেদে অভিযান চালায় তৎকালীন সহকারী কমিশনার সোহেল রানা। তিনি ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটক করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাউন্সিলর মনিরের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর হামলা চালানো হয়। পরে র্যাব-৭ এর সদস্যরা এগিয়ে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের বারাহিপুর এলাকার সাহেব বাজার, বরইয়া রাস্তার মাথা, মৌলভী ইব্রাহীম সড়ক, বারাহিপুর রেলগেটের আলম ব্যাপারী বাড়ি, শিবপুর নূরানি মাদরাসা সড়ক, শহীদ মেজর সালাহউদ্দীন বীর উত্তম মোড, একাডেমি এলাকার মোল্লার দোকানসংলগ্ন স্থান, নাজির রোড, বিরিঞ্চি আতিকুল আলম সড়ক, আলোকদিয়াসহ শহরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে সংযোগ দিয়ে গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। এসব সংযোগ থেকে অনেকেই প্রতি মাসে মাসোহারা আদায় করেন।
জানা গেছে, অবৈধ গ্যাস সংযোগ থেকে উৎকোচ আদায়ের ঘটনায় গিয়াস উদ্দিন নামের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে বাখরাবাদের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

বাখরাবাদের একটি সূত্র জানায়, এখানে সিবিএ নেতাদের দাপটে কর্মকর্তারা তটস্থ থাকেন। তাদের অনেকেই অবৈধ সংযোগের সাথে জড়িত থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও না দেখার ভান করেন।

অপর একটি সূত্র জানায়, এখানে গ্যাস বিল পরিশোধের জন্য রাজস্ব শাখায় বই লিখতে কিংবা বই সংগ্রহে এসে গ্রাহকদের হয়রানির শিকার হতে হয়। কোনো গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও টাকা দিয়ে পুনঃসংযোগের জন্য নথি পাওয়া যায়না। ফলে পুনঃসংযোগ দিতে রাজস্ব শাখার কর্মকর্তাদের বাড়তি টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়া দীর্ঘ দিন ধরে গ্যাসের কাজ স্তিমিত হয়ে পড়ায় কর্মচারীরা ঠিকাদারি কাজ চালিয়ে আসছে। এতে অফিস সময়ে দাফতরিক কাজের চেয়ে বাইরে ঠিকাদারিতে ব্যস্ত সময় কাটান তারা।

বাখরাবাদের ডিজিএম সগির আহম্মদ জানান, কোনো অনিয়মের সাথে বাখরাবাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/563543/