১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৮

ভোজ্যতেলের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করলো সরকার

অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামওয়েল তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতি লিটার ভোজ্যতেলের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন ১১৫ টাকা লিটারে বিক্রি হবে। বোতলজাত সয়াবিনের লিটার বিক্রি হবে ১৩৫ টাকায় । এ ছাড়া পাম সুপার বিক্রি হবে ১০৪ টাকা লিটার দরে। এটা বিগত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর আগে সর্বোচ্চ দাম ছিল ২০১২ সালের মাঝামাঝি। ওই বছর বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া চলতি মাসে বোতলজাত সয়াবিন তেল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম ওঠে। প্রতিলিটার বিক্রি হয় ১৪০ টাকায়।

গতকাল বুধবার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক বিষয়ক জাতীয় কমিটির সভা শেষে সচিবালয়ে সাংবাদি সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ভোজ্যতেলের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে এ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। সামনে রমজান মাস, বর্তমানে যথেষ্ট মজুত আছে। সব হিসাব-নিকেশ করে এ দাম নির্ধারণ করা হয়। বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীনের সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা, বিএফটিআই’র পরিচালক মো. ওবায়দুল আজম, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড টেরিফ কমিশনের সদস্য (বাণিজ্যনীতি) আবু রায়হান আলবেরুনী, এনবি আরের সদস্য (শুল্ক) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রফতানি) মো. হাফিজুর রহমান, ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. হাফিজুর রহমান, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, টিকে গ্রুপের পরিচালক মো. সফিউল আফসার তাজলিম, সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী, এস আলম গ্রুপের সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক কাজী সালাহ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ডিজিএফআই এবং এনএসআই’র প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

শক্ত হাতে দাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, দাম কমে গেলে বিবেচনা করা হবে, বেড়ে গেলেও বিবেচনা করা হবে। আমরা যে তেল ব্যবহার করি তার ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। তিনি বলেন, প্রতি লিটার সয়াবিন (খোলা) মিলগেটে ১০৭ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১১০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ১২৩ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১২৭ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১৩৫ টাকা। ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ৫৮৫ টাকা, পরিবেশক মূল্য ৬০০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ৬২৫ টাকা। আমাদের দেশে যে তেল ব্যবহার করি তার ৭০ শতাংশ পাম সুপার, যার প্রতি লিটার মিলগেট মূল্য (খোলা) ৯৫ টাকা, পরিবেশক মূল্য ৯৮ এবং খুচরা বাজারে ১০৪ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ৫৯০, পরিবেশক মূল্য ৬১০ এবং খুচরা বিক্রয় মূল্য ৬৩০ টাকা।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে ৬৫ শতাংশ তেলের দাম বেড়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘শিপিং কস্টও বেড়েছে। এছাড়া জাহাজের তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও বেড়েছে। অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামতেলের আমদানিতে আরোপিত ভ্যাট ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনা আরও বেশি যৌক্তিকহারে নির্ধারণের জন্য ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ করা হয়েছে। ভোজ্যতেলের মূল্য অস্থিতিশীল থাকায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক বিষয়ক জাতীয় কমিটির সভা প্রতি মাসেই আয়োজন করা হবে বলে জানান মন্ত্রী।

এদিকে বাজারে এখন সয়াবিন তেলের এক লিটারের বোতলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর আগে সর্বোচ্চ দাম ছিল ২০১২ সালের মাঝামাঝি। ওই বছর বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক বছর আগের তুলনায় বাজারে এখন সয়াবিনসহ ভোজ্যতেলের দাম ২১ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি।

ভোজ্যতেলের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে মানুষ। চারজনের ছোট পরিবারে গড়পড়তা মাসে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল দরকার হয়। ফলে শুধু রান্নার তেলের পেছনেই এখন মাসে দেড়শ’ থেকে ১৭০ টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাজারকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, দেশের সয়াবিনের উৎস ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়েতে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম ১ হাজার ১৫০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। এর আগে ২০১২ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩০০ ডলারে উঠেছিল। এবার দাম বাড়ার কারণ চীনের আগ্রাসী কেনা এবং সরবরাহে টান।

দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। মেঘনা, সিটি, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, বসুন্ধরা, টি কে, এস আলম গ্রুপসহ সাত–আটটি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত তেল আমদানির পর তা পরিশোধন করে বাজারজাত করে। কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময় ভোজ্যতেলের ওপর এক স্তরে ভ্যাট আরোপের দাবি জানিয়ে আসছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এর আগে গত বছর ভোজ্যতেল ও চিনির ওপর কর কমাতে কয়েক দফা অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল। তবে কর কমানো হয়নি।

জানা গেছে, লিটারপ্রতি যে ভোজ্য তেলের দাম এক বছর আগে ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করে অভিনব কায়দায় তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়াতে ইচ্ছা করে দেরিতে বাজারে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা দিলে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেন। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার প্রবণতা দেখা দিলে ইস্যু করা সাপ্লাই অর্ডারে ভোজ্য তেল তুলতে অনীহা প্রকাশ করেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের এই কূটকচাল তুলে ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ভোজ্য তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার বাজার মনিটর করছে। কোনো অসাধু ব্যবসায়ী অসৎ উদ্দেশ্যে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে এবং তার প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্যারিফ কমিশন যে সুপারিশগুলো করেছে, তা বিবেচনায় নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বর্তমানে বাজারে পাঁচ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের দাম ৬৫০ থেকে ৬৮৫ টাকা। ছয় মাস আগে এই তেলের দাম ছিল ৫১০ থেকে ৫১৫ টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানে ক্রেতাসাধারণকে বাড়তি দিতে হচ্ছে ১৪০ টাকারও বেশি। বাড়তি এই টাকা দিয়ে আরো প্রায় দেড় লিটার তেল কেনা যেত। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে খোলা সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি বিক্রি হতো ৮২ থেকে ৮৫ টাকা। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। বর্তমানে কম্পানিভেদে তা ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বিদ্যমান সাপ্লাই চেইনের সমস্যাসহ ব্যবসায়ীদের কূটকৌশলগুলো তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খোলা ভোজ্য তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে ভোজ্য তেল পরিশোধনকারী মিলগুলো পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরবরাহের যে আদেশ নেয় তার মেয়াদ ১৫ দিন। কিন্তু দেখা যায়, সরবরাহ আদেশের এই তেল সরবরাহ করা হয় তিন থেকে চার মাস ধরে। এতে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের সাপ্লাই অর্ডার (এসও) বাজারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আবার মিলগুলো ইচ্ছা করে তাদের উৎপাদনক্ষমতার বেশি পরিমাণ সরবরাহ আদেশ ইস্যু করে। এতে চাহিদামতো ভোজ্য তেল সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফলে এই অবস্থায় বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে দাম বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের ভোজ্য তেলের বাজার আমদানিনির্ভর হওয়ায় ব্যবসায়ীরা দাম নিয়ে নানা কূটকচাল চালেন। কমিশন বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা দিলে মিলগুলো আগে ইস্যু করা সাপ্লাই অর্ডারের ভোজ্য তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে নতুন সাপ্লাই অর্ডারের ভোজ্য তেল সরবরাহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। নতুন অর্ডারে দাম বেশি থাকে বলে বাজারে এর নেতিবাচব প্রভাব পড়ে। আবার এর উল্টো চিত্রও দেখা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার প্রবণতা দেখা দিলে সাপ্লাই অর্ডারের মালিকরা মিল থেকে ইস্যু করা ভোজ্য তেল উত্তোলনে অনীহা দেখান। এই অবস্থায়ও বাজারে সরবরাহ চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার মিলগুলো রেগুলার সাপ্লাই অর্ডার ছাড়াও অনেক সময় বিশেষ সাপ্লাই অর্ডার ইস্যু করে। এতেও বাজারে সরবরাহ চেইনে সমস্যা সৃষ্টি হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তেলের করকাঠামো নিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে চিঠি চালাচালি করছে। তবে কর কমছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ভোজ্যতেলের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) এক স্তরের বদলে তিন স্তরে আরোপ শুরু হয়। সব মিলিয়ে যে করকাঠামো, তাতে এক লিটার তেলে প্রায় ২৫ টাকা করবাবদ পায় সরকার। বর্তমান কাঠামোয় বিশ্ববাজারে দাম যত বাড়ে, ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাটের পরিমাণও বাড়ে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের তুলনা করলেই দামের পার্থক্য বোঝা যাবে। সরকারের উচিত অশুভ উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীরা তেল মজুদ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। আর মনিটরিং আরো জোরদার করতে হবে। এমনিতেই করোনার কারণে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে, বেতন-ভাতা, আয় কমে গেছে।

https://dailysangram.com/post/444192