১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ৯:৫৬

দেশে রোমহর্ষক-বীভৎস হত্যাকাণ্ডে বাড়ছে উদ্বেগ

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়েছে বীভৎস, বিকৃত, রোমহর্ষক খুনের ঘটনা। নিষ্ঠুরভাবে খুনের পাশাপাশি মানুষের প্রতি নির্মম অপরাধপ্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রেমিককে খুন করে পাঁচ টুকরো করছে প্রেমিকা। মাকে খুন করছে সন্তান, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, আবার স্বামীর হাতে স্ত্রী, নিষ্পাপ শিশুসন্তানকে ছুঁড়ে মারা হচ্ছে রাস্তায়। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে। ডাস্টবিনে, পানির ট্যাংকে কিংবা ড্রেনে মিলছে লাশ। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ছয় বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ২০ হাজারেরও বেশি। রাজধানীতে প্রতিমাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মাহবুব আলম গতকাল সোমবার বলেছেন, ‘ঢাকায় গড়ে প্রতিমাসে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা ঘটে। এরকমই ফেব্রুয়ারিতে দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছিল। একটি ১০ ফেব্রুয়ারি আরেকটি ১২ ফেব্রুয়ারি।

অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরণের ঘটনার অন্যতম কারণ পারিবারক বিরোধ ও মাদকের অর্থ জোগাড় এবং হতাশা। তারা বলছেন, ইন্টারনেটের অপব্যবহার. অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে বীভৎস বিকৃত খুনের ঘটনার বেশিরভাগই ঘটছে অপেশাদার খুনিদের মাধ্যমে।
সালাম না দেয়ায় কিশোর খুন: সালাম না দেয়ায় রাজধানীর মুগদার মাণ্ডায় কিশোর হাসান মিয়াকে (১৬) খুন করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে সাত কিশোরকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগ। গ্রেফতার সবাই সংঘবদ্ধ কিশোর অপরাধী দলে জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ। গত শুক্রবার রাতে হাসান মিয়াকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুর রহমান বলেন, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে হাসান মিয়াকে খুন করা হয়। তিনি বলেন, খুবই তুচ্ছ কারণে এ খুনের ঘটনা। সালাম না দেয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানিয়েছে। গ্রেফতার সবারই বয়স ১৬-১৭ বছরের মধ্যে। ঘটনার পর পরই এক কিশোরকে আটক করেছিল থানা পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব বলেন, এই কিশোররা ‘ব্যান্ডেজ’ নামে গ্রুপ পরিচালনা করে। নিহত হাসান একটি প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করত। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বারে। মুগদার মাণ্ডায় পরিবারের সঙ্গে ভাড়া বাড়িতে থাকত হাসান।

প্রেমিককে ৫ টুকরা করে হত্যা: রাজধানীর ওয়ারীতে সজিব হাসান নামে এক যুবককে পাঁচ টুকরো করে হত্যা করে তার প্রেমিকা শাহানাজ বেগম। পরে সেই মামলায় তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের পর আদালতে হাজির করা হয়। গত শুক্রবার হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে তিনি আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। আদালতে ওই নারীর জবানবন্দীর বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সজিব হাসানের সঙ্গে শাহানাজ পারভিন ছাড়াও একাধিক নারীর সম্পর্ক ছিল। চার দিন আগে শাহানাজ যখন সজিবের বাসায় ওঠেন, তখন তার গয়নাগাটি বিক্রি করে টাকা দিতে চাপ দিচ্ছিলেন সজিব। শাহানাজকে বাসায় একা রেখে তালা লাগিয়ে সজিব বাইরে যেতেন। এসব পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই সজিবকে ছুরি মেরে হত্যার পর লাশ কেটে পাঁচ টুকরা করেন শাহানাজ। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, আদালত শাহানাজের জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেন। মামলার বাদী নিহত যুবকের খালু নজরুল ইসলাম। তার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় শাহানাজকে। তিনিই মামলার একমাত্র আসামী। নিহত সজিব হাসান ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ড থানার নারায়নকান্দি গ্রামের মৃত আতিয়ার রহমানের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট ছিলেন।

নিহতের খালু নজরুল ইসলাম দাবি করেন, গত ১১ বছর থেকে ঢাকায় শাহানাজ পারভিন নামে এক নারীকে বিয়ে করে সংসার করছে- মাসহ আত্মীয় স্বজন সবাই এমনটি জানত। কিন্তু তিনি তার বক্তব্যের স্বপক্ষে বিয়ের কাবিন বা অন্য কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তার দাবি- শাহানাজ পারভিনকে বিবাহিত স্ত্রী পরিচয় দিয়ে একাধিকবার নিজ বাড়ি ও গাইবান্ধার মালিকাবাদ খালার বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। পরিবারের সবাই শাহানাজকে তাদের ছেলের বৌ হিসেবে জানতেন। তারা শাহানাজের অন্য সংসার ও সন্তানের কথা জানতে পারেন বলে জানিয়েছেন। পরদিনই কাউকে কিছু না বলে ব্যাগভর্তি কাপড়চোপড় স্বর্ণালংকার ও গয়নাগাটি নিয়ে সজিবের বাসায় ওঠেন শাহনাজ। বাসায় ওঠার পর শাহনাজ জানতে পারেন তিনি ছাড়াও সজীবের একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। গত বৃহস্পতিবার সকালের দিকে সজিবের সঙ্গে তার কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সজিব তাকে লাঠিপেটা করেন এবং ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা করেন। এ সময় শাহনাজ সজিবের কাছ থেকে ছুরি কেড়ে নিয়ে তাকে আঘাত করলে মারা যায়।

সাবেক স্ত্রী ও শ্যালিকা খুন : রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাবেক স্ত্রী ও শ্যালিকাকে হত্যার অভিযোগে এক রিকশাচালককে আটক করে পুলিশ। গত ৯ জানুয়ারি দুপুরে পূর্ব নাখালপাড়া সমিতি বাজারসংলগ্ন একটি টিনশেড ঘর থেকে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তেজগাঁওয়ে পূর্ব নাখালপাড়া সমিতি বাজার সংলগ্ন এক বাড়িতে শনিবার আলামত সংগ্রহে সিআইডি পুলিশ। বাড়িটিতে এক রিকশাচালক তার সাবেক স্ত্রী ও শ্যালিকাকে হত্যা করেছে। এঘটনায় রনি মিয়া নামে এক রিকশাচালককে আটক করা হয় বলে জানিয়েছেন শল্পাঞ্চল থানার ওসি বিপ্লব কিশোর শীল। তিনি বলেন, স্থানীয় লোকজন রনিকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
মাকে পাঁচ টুকরো করে ছেলে : গত ৭ই অক্টোবর বিকালে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের জাহাজমারা গ্রামের এক’টি বিলের মাঝের বিভি’ন্ন জায়গা থেকে নূর জাহান নামে ওই গৃহবধূর ৫ খণ্ডিত লাশহ উদ্ধার করা হয়। ক্লু লেস এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন, হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের চিহ্নিত করা, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রসহ অন্যান্য আলামত উদ্ধারে জেলা পুলিশ সুপার মো আলমগীর হোসেন এর নেতৃত্বে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নামে। পরবর্তীতে সুবর্ণচর উপজে’লার চরজব্বার ইউনিয়নের জাহাজমারা গ্রামে নূর জাহানকে (৫৮) পাঁচ টুকরো করে হত্যার ঘটনায় তার ছেলে হুমায়ন ক’বিরসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা পাঁচ আসামী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। এর আগে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো আনোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন সংবাদ সম্মেলন করেন। ২২ অক্টোবর বিকেলে তারা নোয়া’খালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। জেলা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আলতাফ হোসেন জানান, সুবর্ণচরে গৃহবধূ নূর জাহানকে পাঁচ টুকরো করে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত হুমায়ন কবির, সুমন, কালামকে বিকালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করলে গ্রেফতার নীরব ও কসাই নূর ইসলাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মায়ের জিম্মায় আনা সুদের টাকা পাওনাদারদের না দিয়ে এবং পৈতৃক সম্পত্তি আত্মসাৎ করতেই তাকে পরিল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে জানান চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।

এক রাতেই পরিবারের সবাই খুন: সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলায় একই পরিবারের স্বামী, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ চারজনকে গলা কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। হত্যাকারীরা ওই পরিবারের চার মাসের শিশু মারিয়াকে হত্যা না করে ফেলে রেখে যায়। গত বছর ১৫ অক্টোবর ভোরে উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নের খলিসা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- মাছের ঘের ব্যবসায়ী মো. শাহীনুর রহমান (৪০), তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন (৩০), ছেলে সিয়াম হোসেন মাহী (৯) ও মেয়ে তাসমিন সুলতানা (৬)। এদিকে জীবিত থাকা একমাত্র শিশুকন্যা মারিয়া সুলতানাকে স্থানীয় ইউপি সদস্য নাসিমা খাতুন নিয়ে যান। পরে তিনি তাকে আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করেন। স্থানীয়রা জানান, ভোরে তারা ওই বাড়ির চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সেখানে যান। পরে দরজা খুলে দেখতে পান সাবিনা খাতুন ও তার দুই শিশু তাসনিম ও মাহী একঘরে এবং আরেক ঘরে শাহীনুরের গলা কাটা লাশ। একই পরিবারে থাকা শাহীনুরের ছোটভাই রায়হানুল ইসলাম জানান, তিনি গোঙানির শব্দ শুনে ছুটে যান। পরে সবাইকে খবর দেন। হত্যাকারীরা সিঁড়ির ঘর দিয়ে ঢুকে তাদের খুন করে দরজায় শিকল দিয়ে চলে যায়।

https://dailysangram.com/post/444090