১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ৯:৫৫

সর্বস্তরে ধর্মশিক্ষা

জাতীয় শিক্ষানীতির ভিত্তিতেই শিক্ষার সব পরিমণ্ডল আবর্তিত হয়। কোর্স কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণীত হয়ে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়। সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২০’ এ খসড়া কারিকুলাম প্রকাশ করেছে, সেখানে জাতীয় শিক্ষানীতির সাথে সাজুয্যপূর্ণ ও জাতির মনন গঠনের জন্য উপযুক্ত উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটেনি। রয়েছে অস্পষ্টতাও।

‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২০’ এ ধর্ম শিক্ষাকে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণী প্রর্যন্ত পঠন-পাঠনে রাখা হয়েছে এবং এ বিষয়ে বিদ্যালয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। (পৃ:৯৭)। কিন্তু পাবলিক (বোর্ড) পরীক্ষায় ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টি রাখা হয়নি। পাবলিক (বোর্ড) পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত রাখা না হলে বিষয়টি আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়বে। কারণ শিক্ষার্থীরা গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি পড়বে না বরং সর্বতোভাবে এড়িয়ে যাবে। তাই দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ের আকাক্সক্ষা বিবেচনায় নিয়ে আগের মতো ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টি বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটাই ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রাণের দাবি। আমরা আশা করি, সরকার তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে।

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীকে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২০-এ মাধ্যমিক স্তর বলা হয়েছে ১. শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী এ স্তরে নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২০-এ ‘মূল্যবোধ ও নৈতিকতা’ বিষয়ে একটি নতুন শিখন-ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।

ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান, ব্যবসায় ও মানবিকসহ সব শাখা ও বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য আবশ্যিক-নৈর্বাচনিক বিষয় হিসেবে পঠন-পাঠন এবং বোর্ড পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। তাই এ ব্যাপারে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এটি দেশের সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মানুষের একান্ত দাবি।

এ কথা সবার জানা যে, মানবজীবনে শিক্ষার ভিত্তিভূমি হলো শিশুকাল। এখানে যা কিছু শেখানো হবে, তাই আজীবন তাদের হৃদয়ে রেখাপাত করবে। তাই শিশুর প্রথম পাঠ, প্রথম পড়া হতে হবে পরম প্রভু স্রষ্টার নামেÑ যিনি সৃষ্টি করেছেন। এটা শিশুর জন্মগত অধিকার। শিশুর ধর্মীয় জ্ঞান মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাÑ তথা উপাসনালয়ের মধ্যে সীমিত না রেখে প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত গুরুত্বসহ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে। কেননা জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে ‘প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব বেসরকারি বা এনজিও খাতে হস্তান্তর করা যাবে না’ (প্র: প্রাক-কথন, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০)। কাজেই শিশুর ধর্মমূলক শিক্ষার বাইরে চলে যাওয়া শিক্ষানীতি-২০১০-এর পরিপন্থী।

উচ্চশিক্ষার সব শাখা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ব্যবসায় প্রশাসন, কলা, কারিগরি, মেডিক্যালসহ সব স্তরে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ ও ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ বিষয়ের মতোই ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ আবশ্যিক বিষয় হিসেবে চালু রাখা একান্ত প্রয়োজন। তা ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর জন্য তাদের নিজ নিজ ধর্মের মৌলিক বিষয়সহ ‘মূল্যবোধ ও নৈতিকতা’ নামক একটি বিষয় আবশ্যিক হিসেবে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করাও সরকারের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। এ জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পদ সৃষ্টি করে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগদানের ব্যবস্থাও করতে হবে। তাই শিক্ষার সব পরিমণ্ডলে আদর্শ জীবন গড়ার লক্ষ্য হিসেবে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনাদর্শ এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের তাদের নিজ নিজ ধর্মের প্রবর্তকদের জীবনাদর্শ পঠন-পাঠন বাধ্যতামূলক করা জরুরি।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের এই বাংলাদেশে সব ধর্মের শিক্ষার আলোকে যাতে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আলোকিত মানুষ তৈরি হতে পারে তার ব্যবস্থা করা সরকারের একান্ত কর্তব্য। আর সে কারণেই মাধ্যমিক স্তরে পাবলিক (বোর্ড) পরীক্ষার ব্যবস্থা করা দেশের গণমানুষের হৃদয়ের একান্ত দাবি। একই সাথে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী থেকে শিক্ষার সব স্তরে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা অতীব জরুরি। আশা করি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

লেখক : প্রাক্তন কলেজ শিক্ষক ও সাবেক সিনেট সদস্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/563408/