১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ৯:৫৩

বাংকিং খাতে নৈরাজ্য ও আমাদের গন্তব্য

দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি ও আইনের শাসনের অভাবেই লুটেরারা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ। মূলত অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই ব্যাংকিংখাতসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অব্যবস্থাপনা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বেড়েছে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থপাচারও। বিষয়টি উদ্বেগে হলেও এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। কারণ, এই খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজে বের করার দায়িত্ব যাদের তারাই এখন বড় ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে মহাপ্রলয়ের আভাষ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ব্যাংকিংখাতসহ অর্থনৈতিক সেক্টরে অনিয়মের কারণেই আমাদের অর্থনীতি মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। আর্থিক খাতের এই নৈরাজ্যকর অবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং একশ্রেণির কর্মকর্তার লাগামহীন দুর্নীতিকে দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখানে দুই ধরনের দুর্বলতা রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে অভিজ্ঞমহলের পক্ষ থেকে। একটি হলো পলিসিগত বা রাজনৈতিক দুর্বলতা, অপরটি হচ্ছে ব্যক্তি স্বার্থ বা অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাস। আর এই দুর্বলতাগুলোই আমাদের অর্থনীতির জীবনী শক্তিকে ক্রমেই ম্লান করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তারা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন এমন কিছু কথা অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু প্রমাণভিত্তিক ছিল না। কিন্তু দুর্নীতির বরপুত্র রাশেদুল হক গ্রেফতার ও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেক অজানা তথ্যই আলোর মুখ দেখেছে। কিন্তু একজন রাশেদুল সবকিছুই করেছেন এমনটি নয় বরং আরও অনেক রাশেদুল রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না সে প্রশ্নের কোন কুলকিনারা হচ্ছে না। ফলে সমস্যা সমস্যাই থেকে যাচ্ছে।

শুধু ব্যাংক কর্মকর্তারাই নন বরং এই অপকর্মের সাথে জড়িত আছেন আরও অনেকেই। কারণ, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে নিরাপদে পাচার করতে একটি বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে দুর্নীতির রাজপুত্ররা। ইতোমধ্যেই অর্থপাচার কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের ৬২ জন সহযোগীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হিসাবে থাকা ১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সূত্র বলেছে, কমিশন জানতে পেরেছে, অর্থ পাচারে সহায়তা করার জন্য পিকে হালদার শত শত লোকের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। যারা তাকে অর্থপাচারে সহায়তা করেছিলেন তাদের মধ্যে ৬২ জনের খোঁজ পেয়েছে অ্যান্টি-গ্রাফট কমিশন এবং তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। দুদক দাবি করছে, পিকে হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আর তাকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করেছেন ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষকর্তারা।

উল্লেখ্য, পিকে হালদারের অনিয়মের সহযোগী হিসেবে আটক ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীতে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম ও পরিদর্শন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে তিনি জানিয়েছেন, তাদেরকে নিয়মিত মাসোয়ারা দেওয়া হতো। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফিসিয়াল আদেশে নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে।

আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে রাশেদুল হক জানিয়েছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের মাসোয়ারা দেওয়া হতো। এসব অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। এদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা করে ঘুষ নিতেন।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সংঘটিত (হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ) আর্থিক কেলেঙ্কারি ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা স্তরের নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ কেউ এসব ব্যাংকে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেনি। উদ্বেগের বিষয়, এসব অনিয়ম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে পুরো অর্থনৈতিক সেক্টরেই চলছে অস্থিরতা ও লাগামহীন নৈরাজ্য।
এমনিতে আমাদের দেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। বর্তমানে এই খাতের প্রথম সমস্যা সুশাসনের অভাব। দ্বিতীয় সমস্যা এ খাতের জন্য প্রণীত নীতিমালা ও আইনকানুন, কোম্পানি আইন, আন্তর্জাতিক নীতিমালাসহ প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে না। প্রচলিত বিধিমালা আন্তর্জাতিক মানের হলেও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সঙ্গত কারণেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক ও নিম্নস্তরের কর্মকর্তা পর্যায়ে কোথাও সুশাসন ও শৃঙ্খলা নেই। ফলে সর্বত্রই মারাত্মক ত্রুটি-বিচ্যুতি ও নানাবিধ অনিয়ম পরিলক্ষিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের অবস্থা এখন মোটেই স্বস্তিদায়ক নয় বরং একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যেই চলছে রাষ্ট্রীয় এই অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

বিশেষত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্বিক নির্দেশনা দেবে, নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে আর ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন-এটাই প্রচলিত নিয়ম। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কার্যপরিধি আইন দিয়ে নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায় যে, পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাজে অনাকাক্সিক্ষতভাবে হস্তক্ষেপ করে থাকে। ফলে দেখা যায়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নীতিগত সিদ্ধান্ত দেওয়ার চেয়ে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতেই অতি আগ্রহী। এমতাবস্থায় ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের পক্ষে স্বাধীন, আইনানুগ ও ইনসাফপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। অবশ্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনাও যে সব সময় দক্ষ হয়, এমনও নয়। অনেক সময় ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও ত্রুটির কারণেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে এক্ষেত্রে অবৈধ হস্তক্ষেপই মুখ্য।

মূলত নানাবিধ কারণেই ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি বেশ স্পষ্ট। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরস্পরকে দোষারোপ করার প্রবণতাও অবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য কম দায়ি নয়। ফলে জবাবদিহির বিষয়টি এখন গৌণ হয়ে পড়েছে। ব্যাংক খাতে নজরদারি ও তদারকিও খুব দুর্বল। যাঁরা পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালক হয়ে আসেন, তাঁদের নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে। তাঁরা আত্মীয়স্বজনের ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা দেওয়ার জন্যও ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের ওপর অনৈতিক প্রভাব খাটান। নিজের লোকদের ঋণ বা চাকরি দেওয়ার জন্য তাঁরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দেন প্রতিনিয়ত।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যাঁরা নিয়োগ পান, তাঁদের নিযুক্তি অনেকটাই নির্ভর করে পরিচালনা পর্ষদের ওপর। সঙ্গত কারণেই তাঁরা ইচ্ছা করলেই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা চেয়ারম্যানের পরামর্শ বা নির্দেশনা উপেক্ষা করতে পারেন না। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থাকবেন কি থাকবেন না, তা অনেকটাই নির্ভর করে ওই ব্যক্তির ওপর পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের সন্তুষ্টির ওপর। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দক্ষতা ও কাজের সাফল্যের ওপর তাঁর টিকে থাকা, না থাকা তেমন একটা নির্ভর করে না। পরিচালনা পর্ষদে অনেকেই থাকেন, যাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অবৈধ রাজনৈতিক প্রভাব বহুলাংশে দক্ষ ও সৎভাবে ব্যাংক পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করে। ফলে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রশ্রয় পায়।

পরিচালকদের অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চান। কারণ তারা রাজনৈতিকভাবেই নিয়োগপ্রাপ্ত। একজন পরিচালক বা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থাকতেই পারে; কিন্তু তা যদি ব্যাংকের কাজে ব্যবহার করতে চান, তাহলেই সমস্যা দেখা দেয়; ভেঙে পড়ে শৃঙ্খলা। ব্যবস্থাপনার মধ্যেও অনেকে আছেন, যাঁরা দক্ষ নন, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদি অদক্ষ বা দুর্বল হন, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্রই পড়ে। এতে নিচের দিকের কর্মীরা নানা দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। দুর্নীতি-অনিয়ম ওপর থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়। কাজেই টপ ম্যানেজমেন্ট যদি কঠোরভাবে সুশাসন নিশ্চিত করে, তাহলে তার প্রভাব নিচের দিকে পড়তে বাধ্য। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্র টপ ম্যানেজমেন্টের মধ্যেও সমস্যা রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে এখন সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জাতীয় অর্থনীতির ওপর। ফলে আমাদের সার্বিক অর্থনীতি এখন প্রাণহীন হতে শুরু করেছে।

ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান সংকট ও অচলাবস্থার জন্য সুশাসনের ঘাটতির বিষয়টিই মুখ্য। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি দায়িত্ব বিবেচনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি সম্প্রতি নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সংজ্ঞায়, স্বচ্ছতা হলো এমন এক পরিবেশ সৃষ্টিকরা, যেখানে মুদ্রা ও আর্থিক নীতিসম্পর্কিত সব তথ্য সময় সময় জনগণকে বোধগম্য উপায়ে জানানো হয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে টেকসই সুশাসন ও সার্বিক আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি কার্যপরিচালনায় স্বচ্ছতা বিধান পূর্বশর্ত। জবাবদিহি হলো পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে বিদ্যমান সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারি কোনো এজেন্ট কর্তৃক সুলভে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান। আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণকারী প্রধান গোষ্ঠী ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতা, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী, জাতীয় কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি পরস্পর সম্পর্কিত। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে নজরদারি বাড়ে। আবার জবাবদিহি থাকলে স্বচ্ছতা বাড়ে। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই নিশ্চিত হয় যে মানুষ তাদের কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনেছে এবং বুঝেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির যথার্থ উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংকে সংঘটিত হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সেখানে ঋণগ্রহীতা ও কর্মকর্তারা গোপন সমঝোতার মাধ্যমে অস্বচ্ছ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সে ঘটনায় যাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বরং অভিযুক্তরা নানাভাবে আনুকূল্যই পেয়েছে। অবহেলার শিকার হয়েছেন সৎ, যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তারা। ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

আমাদের ব্যাংকিং খাতে লাগামহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি পর্যবেক্ষণেও স্থান পেয়েছে। ‘ব্যক্তিগত লাভের বিনিময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাই দেশের অর্থ আত্মসাতকারী ও অর্থপাচারকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন’-সম্প্রতি এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন দেশের উচ্চ আদালত।

মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ পর্যবেক্ষণে বলেছেন, দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য যে, সরকার প্রধান যখন এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করছেন, যখন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিংয়ের কাজ করার কথা, সেখানে ব্যাংকটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, জেনারেল ম্যানেজার, নির্বাহী পরিচালক ও ডেপুটি গভর্নররা ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য অর্থপাচারকারী ও অর্থআত্মসাতকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে মাতৃভূমির অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ২০০২ সাল থেকে আজ অবধি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উচিত এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধান চালানো।

আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে শনির আছর পড়েছে বেশ আগেই। মূলত, গণতান্ত্রিক শাসনের বিচ্যুতি ও সুশাসনের অভাবেই দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচার রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। আর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতের ওপর। যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তাদের লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। ফলে পুরো সেক্টরই এখন অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় দেশের ব্যাংকিং খাত ও অর্থনৈতিক সেক্টরকে রাজরাক্ষসদের হাত থেকে বাঁচাতে দুর্র্নীতির কুশীলব ও নেপথ্য শক্তিকে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় অর্থনৈতিক সেক্টরে মহাপ্রলয় ঠেকানো যাবে না; আমাদের গন্তব্যও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

https://dailysangram.com/post/444088