১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১১:৪৮

ছাত্রলীগ নেতার হাতে ইভিএম

নাজমা আক্তার। এবারই তাঁর প্রথম ভোট। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে তাঁর অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছিল। নাজমা সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আলেকজান্ডার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে যান। নারী বুথের কালো পর্দার বাইরে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সামনে নিয়ে দিব্বি বসে আছেন। কামালের মুখে নৌকা প্রতীকের মাস্ক আর ব্লেজারে লাগানো লোগো। কিছুক্ষণ পরই সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ইউসুফ আলী নাজমাকে সব প্রক্রিয়া শেষ করে ভোট দেওয়ার জন্য ইভিএমের দিকে পাঠান। কামালের সামনে থাকা ইভিএমে তাঁকে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়। পরে তিনি পর্দার ভেতর গিয়ে সেখানে রাখা অন্য ইভিএমে কাউন্সিলর পদে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। ইভিএম নিয়ে বসে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেকে নৌকার এজেন্ট বলে দাবি করছিলেন।

শুধু নাজমা আক্তারকেই নয়, লক্ষ্মীপুরের রামগতি পৌর নির্বাচনে কেন্দ্রের গোপন কক্ষের বাইরে ইভিএম রেখে প্রকাশ্যে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে ভোটারদের বাধ্য করা হয়েছে। গোপন কক্ষের পর্দার বাইরে ইভিএম নিয়ে বসে ছিলেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এম মেজবাহ উদ্দিন মেজুর সমর্থক ও এজেন্টরা। কেন্দ্রে ভোটাররা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার পর ওই সমর্থক ও এজেন্টরা প্রকাশ্যে নৌকার সামনের সুইচে চাপ দিয়ে ভোট দিয়েছেন। তবে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীর ভোট গোপনে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন ভোটাররা। গতকাল রবিবার নির্বাচন চলাকালে সাতটি কেন্দ্র ঘুরে এমন ছবিই চোখে পড়েছে।

এদিকে কেন্দ্রে এসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মেলায় হাজারো ভোটার ভোট না দিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। এমনকি দুপুর ১টার দিকে আলেকজান্ডার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে খোদ নৌকার প্রার্থী মেজবাহ উদ্দিন মেজু বিড়ম্বনায় পড়েন। তিনি চেষ্টা করেও ভোট দিতে পারেননি। ঘণ্টাখানেক পর হাত পরিষ্কার করে তিনি ভোট দিয়েছেন। অনেকেই কেন্দ্র আঙিনায় সাবান দিয়ে একাধিকবার হাত ধুয়ে আবার চেষ্টা করেও ভোট দিতে পারেননি। এ নিয়ে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাঁদের ভাষ্য, রোদের মধ্যে এক-দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে গেলে ফিঙ্গার মিলছিল না।

অন্যদিকে প্রকাশ্যে ইভিএম দখল করে নৌকায় ভোট, এজেন্ট ঢুকতে না দেওয়া ও মারধর করার অভিযোগ এনে সকাল ১১টার দিকে আলাদাভাবে সাহেদ আলী পুটু (ধানের শীষ), আলমগীর হোসেন (লাঙল), আবি আবদুল্লাহ (নারিকেলগাছ) ও মো. জামাল উদ্দিন (জগ) নির্বাচন বর্জন করেছেন। ওই চার প্রার্থী আওয়ামী লীগের মেজবাহ উদ্দিন মেজু ও তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে যান।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আলেকজান্ডার সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, চর হাসান হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর ডাক্তার আশ্রম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মধ্য চর আবদুল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্র ও আশপাশ এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দলবদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন। কেন্দ্রগুলোর ভেতরের বুথেও আওয়ামী লীগের এজেন্ট পরিচয়দানকারী যুবকরা প্রকাশ্যে ভোটারদের বোতাম টিপে দিচ্ছেন। নৌকায় ভোট দিতেও বাধ্য করা হয়। প্রতিবাদ করায় আলেকজান্ডার সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র প্রার্থী সাহেদ আলী পুটুর সঙ্গেও তাঁদের বাগবিতণ্ডা হয়। আওয়ামী লীগের উত্তেজিত নেতাকর্মীরা বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কয়েকজন এজেন্টকেও কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছেন।

আলেকজান্ডার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং অফিসার আহসান জানান, বুথের কালো পর্দার ভেতর ইভিএম থাকার কথা। বাইরে ইভিএম রেখে ভোট দেওয়ার বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি।

চর হাসান হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. মিজানুর রহমান বলেন, সমস্যার কারণে অনেকেই ভোট দিতে পারেননি। কী কারণে এমনটি হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেননি তিনি।

ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আবদুর রহিম জানিয়েছেন, বৃদ্ধদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে সমস্যা হয়েছে। যাঁদের প্রিন্ট মেলেনি, তাঁদের হাত পরিষ্কার করে আসতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া যাঁদের বেশি সমস্যা ছিল, নির্বাচনী আইন অনুযায়ী প্রিসাইডিং অফিসার তাঁদের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন।

রামগতি পৌরসভা নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার কাজী হেকমত আলী বলেন, ‘ভোট বর্জনের বিষয়টি শুনেছি। বাইরে ইভিএম রেখে নৌকায় ভোট দেওয়ার বিষয়ে আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন শেষ হয়েছে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/02/15/1005088