২৭ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ১:২৬

ব্যাংকখাত

অনিয়ম আর দুর্নীতির স্থায়ী আখড়া

বহমান এই সময়ে

জি. মুনীর
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা এখন পরিব্যাপক। যতই দিন যাচ্ছে, এ খাতে দুর্নীতি ততই বেড়ে চলেছে। অনেক ব্যাংকে নিয়মকানুনের বালাই নেই। অনেক ব্যাংক পরিণত হয়েছে দুর্নীতির স্থায়ী আখড়ায়। ব্যাংক খাতের নানা ধরনের কাণ্ডকীর্তির খবর প্রায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে। এসব খবর থেকে সহজেই অনুমেয়, গোটা ব্যাংক খাতে অনিয়ম আর দুর্নীতি স্থায়ী বাসা বেঁধেছে। ফলে গ্রাহকসাধারণ ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। কারণ, গ্রাহকসাধারণ দেখছে এসব অনিয়ম আর দুর্নীতির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে নানাভাবে। ফলে এসব ঘটনা শুধু বেড়েই চলেছে। সোনালী ব্যাংকের বহুল আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারি ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে পেরেছে নানা ব্যাংকের নানামাত্রিক ঋণ কেলেঙ্কারি, চেক জালিয়াতি, বিনিয়োগ প্রতারণা ও নানা ধরনের অনিয়ম। বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পেরেছে বেসিক ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নানা অনিয়মের কথা। এই ব্যাংক তিন বছরে ছয় হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যার মধ্যে তিন হাজার কোটি টাকা অ্যাডভান্স করা হয়েছে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে। আর দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে তিনটি শাখা থেকে। এসব ঋণ দেয়া হয়েছে যথার্থ কোনো নিয়ম অনুসরণ না করেই। এসব ঋণগ্রহীতার নাম দেশবাসী জেনেছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর। আর শাখা তিনটি হচ্ছে : গুলশান, শান্তিনগর ও দিলকুশা। এই ঋণ এখন বেসিক ব্যাংকের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অনিয়মের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো নেয়াই হয়নি, বরং তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ এ ধরনের অভিযোগের কথা শুনতে পাচ্ছেÑ রাজনৈতিক চাপের মুখে কোনো কোনো ব্যাংক অনেক ভুয়া কোম্পানিকেও কোটি কোটি টাকার ঋণ দিতে বাধ্য হয়েছে। অনেক অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে এ ধরনের ভুয়া কোম্পানিও ঋণ পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োজিত পরিচালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের পক্ষ থেকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের নানা ধরনের চাপের মুখে ঋণ বিতরণ করতে হয়েছে।


লোকাল এলসি খুলে ভুয়া কোম্পানিগুলো লাখ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে। অনেক অনিয়মের কথা বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পারলেও বাংক বা ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শুধু ব্যাংকগুলোর নির্বাহী কর্মকর্তাদের নামে বারবার চিঠি দিয়েই কেন্দ্রীয় বাংক এর দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি এক অভূতপূর্ব ঘটনা। নিশ্চিতভাবে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ওপর। হলমার্ক গ্রুপ ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আরো কয়েকটি গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে লোকাল এলসি খুলে তুলে নিয়েছে তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ ধরনের জালিয়াতির ফলে এ ব্যাংকের আমানতকারীরা এখন শঙ্কিত। বিষয়টি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য শুভ নয়। কারণ, গ্রাহকদের আস্থা নিয়েই ব্যাংক খাতকে এগিয়ে যেতে হয়। সেই সাথে আস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি তার চেয়েও বড় মাপের ভূমিকা পালন করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। কিন্তু সেই ভূমিকা পালন করতে পারছে না যেমন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো, তেমনি পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংকও। এখানে রাজনৈতিক প্রভাব একটি বড় সমস্যা হিসেবে কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন, যত দিন ব্যাংক খাত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা না যাবে, তত দিন ব্যাংক খাতের সার্বিক কর্মকাণ্ডে অনিয়ম আর দুর্নীতি ঠেকানো যাবে না। কার্যত আমরা দেখছিও তাই। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি নিয়ে এত আলোচনার পরও থামছে না এই দুর্নীতি আর অনিয়ম।


কোনো বাছবিচার ছাড়াই যাকে ইচ্ছা তাকে ঋণ দেয়া হচ্ছে কোনো নিয়মকানুন অনুসরণ না করেই। আগে আমরা অনেক ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ বিতরণের নানা কাহিনীর কথা গণমাধ্যমসূত্রে জেনেছি। সম্প্রতি একটি সহযোগী দৈনিক জানিয়েছে, একটি ব্যাংকের বড় কর্তার অবৈধ প্রভাবসূত্রে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী পেতে যাচ্ছেন ২০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ। ঘটনাটি খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণদাতা ব্যাংকের এমডি স্বীকার করেছেন, আগে প্রকল্পঋণ দেয়ার পর নতুন করে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে এ ঋণ দিচ্ছেন তারা। জানা গেছে, এই ঋণ অনুমোদনের পেছনে প্রভাব খাটাচ্ছেন ব্যাংকটির চেয়ারমান নিজে। ঘটনাটি ঘটেছে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকে। এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হলেন এস এম আমজাদ হোসেন। আর ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মেসার্স আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো এক্সপোর্ট। অভিযোগ আছে, আমজাদ হোসেন নিজেই এই প্রতিষ্ঠানের মালিক। আলোচিত এ ঋণের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকেও অভিযোগ আছে। জানা গেছে, আলফা এক্সেসরিজ নামের যে প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে ঋণ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে, তার মালিক হচ্ছেন ব্যাংকটির চেয়ারমান এস এম আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘লকপুর গ্রুপ’-এর কর্মকর্তা মো: আরজান আলী এবং আপন ভাই রুহুল কুদ্দুসের ১৯ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া কন্যা মাহফুজা খানম রিশা। সূত্র মতে, অনিয়মের মাধ্যমে ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রভাব খাটিয়ে নিজ মালিকাধীন এ প্রতিষ্ঠানটিকে প্রথম দফায় ফান্ডেড ঋণ হিসেবে ৩৩ কোটি টাকা এবং নন-ফান্ডেড খাতে ১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করে। এর পর ঋণদাতা ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের কোনো অনুমতি না নিয়েই এ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ‘মেয়াদি ঋণ’ খাতে আট কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং আমদানি ঋণের খাতে দুই কোটি ১৬ লাখ টাকার অতিরিক্ত ঋণসুবিধা দেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী এসব ঋণের অনুমোদনে কোনো মার্জিন দেয়া হয়নি। এমনকি প্রয়োজনীয় জামানতও ছিল না। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে প্রভাব খাটিয়ে চেয়ারম্যানের নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে এ ধরনের ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে ধরা পড়ে গত বছর।


এ দিকে বেসিক ব্যাংকে এমন সব অনিয়ম আর দুর্নীতি ঘটছে, যা সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করে। সেখানে হিসাব খোলার আগেই ঋণ অনুমোদনের ঘটনা ঘটেছে। নয়া দিগন্তের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়Ñ অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে বেসিক ব্যাংক। গ্রাহক হিসাব খোলেননি, অথচ এর আগেই তাদের অনুকূলে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। এমনকি পরিচালনা পর্ষদে উত্থাপন না করেই বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া হয়েছে। কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কেবল চেয়ারম্যানের ক্ষুদ্র নোটে নিয়োগ দেয়া হয়েছে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। এমন ১৭ ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বেসিক ব্যাংকে। সম্প্রতি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের তথ্য তুলে ধরেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বেসিক ব্যাংকের অনিয়মের সাথে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, পরিচালকবর্গ এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অধিকাংশ ঋণ কোনোরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়া অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবেদনের দুয়েক দিনের মধ্যেই অনুমোদন করা হয়েছে। এমনকি গ্রাহকের হিসাব খোলার আগেই ঋণ অনুমোদিত হিসেবে পর্ষদের কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দিন-তারিখ ও ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে এসব জালজালিয়াতির উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়Ñ শাখা ঋণ কমিটি ও প্রধান কার্যালয়ের ঋণ কমিটি ঋণ মঞ্জুরির বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য দেয়ার পরও তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ ১৮৭ গ্রাহকের অনুকূলে পাঁচ হাজার ৯৯৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। সবিশেষ উল্লেখ্য, ব্যাংক কোম্পানি আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে : ‘কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতার অনুকূলে কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনোরূপ ঋণসুবিধা প্রদান করিবে না।’ বিষয়টি প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির মতামত ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের স্মারকলিপিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও পরিচালনা পর্ষদ একাধিক ঋণখেলাপির অনুকূলে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়নে দেখা গেছে, বড় অঙ্কের ঋণে নয়, ছোট ছোট ঋণেও বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। খবরে প্রকাশ, রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে (বিডিবিএল) গণহারে ঋণে অনিয়ম করা হচ্ছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১১ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটির আশুগঞ্জ শাখা। এর মধ্যে অনেক অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানও ঋণ পেয়েছে। বর্তমানে শাখাটির ৭৮ শতাংশ ঋণই খেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এসব ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো নিয়মের অনুসরণ করেননি। উল্টো গুরুতর অনিয়ম ও জালিয়াতি করা হয়েছে। এর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংক শাখাটি হুমকির মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ উল্লেখ করেনÑ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি তোষণের কারণে বিডিবিএলের আজকের এই পরিণতি। তার মতে, সরকারি ব্যাংকগুলোর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এর দায়ভার নিতে হবে। পাশাপাশি জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিও তিনি আহ্বান জানান।


সার্বিক বিবেচনায় আমাদের ব্যাংক খাত ভালো চলছে না। ফলে দেশের ব্যাংক খাতে বাড়ছে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ। এতে কমছে মূলধন সংরক্ষণের সক্ষমতা। আর এই সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ব্যাংকের ঝুঁকিসহন ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। এতে বাড়ছে ঝুঁকির তীব্রতা। গত বছরের জুনে ব্যাংক খাতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ছিল সাত লাখ ৪৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৭৫ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। মাত্র ছয় মাসে তা বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এত মূলধন সংরক্ষণের হারও আলোচ্য সময়ে কমে গেছে। সব মিলিয়ে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে সাতটি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভুয়া ঋণ ও পর্যাপ্ত জামানত না রেখে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক তদবির ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ দিলে বেড়ে যায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কমে যায় ব্যাংকের আয়। ফলে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যায়।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক-তহবিল লোপাটের ঘটনা বলে বিবেচিত এ ঘটনায় চুরি হওয়া আট কোটি ১০ লাখ ডলার চলে গিয়েছিল ফিলিপাইনের ব্যাংক ও জুয়ার বাজারে। এ অর্থ ফেরত আনার জন্য বাংলাদেশ সরকার এখন চেষ্টা-তদবির করছে। এর কিছু টাকা ফেরত এলেও বাকিটা ফেরত আসার বিষয়টি স্থবির হয়ে আছে। এই স্থবিরতার দু’টি কারণ জনালেন ফিলিপাইনের এনকোয়ারার পত্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাক্সিম লুকাস। তিনিই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি প্রথমে বিস্তারিত ফাঁস করে বাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এই চুরি যাওয়া অর্থের বাকি অংশ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে স্থবিরতার প্রথম কারণ হচ্ছে, ফিলিপাইনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। দ্বিতীয়ত, সে দেশের অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তহবিল লোপাটের ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই ভেতরের লোক। সাংবাদিক লুকাস জানিয়েছেন, ফিলিপাইনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে বলেছেনÑ বাংলাদেশ অযথাই ফিলিপাইনের ওপর বেশি দোষ চাপাচ্ছে। অপরাধীরা হয়তো ঢাকায়ই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এ দিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩ তলায় হঠাৎ করে আগুন লাগে। রাত ৯টার দিকে বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মাসুদ বিশ্বাসের কক্ষ থেকে এ আগুনের সূত্রপাত। পড়ে এ আগুন ১৪ তলায় ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আধা ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১০টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ লেখা পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃতি ও পরিমাণ জানা যায়নি। ঘটনা তদন্তে পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে ব্যাংক খাতের দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও রিজার্ভ চুরির মূল হোতারা জড়িত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আমাদের সরকারি খাতের বাংকগুলোতে চলা দুর্নীতি এসব ব্যাংককে কার্যত ফোকলা করে ফেলা হয়েছে। আর এসব সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতি আর অনিয়মের দায় মেটানো হচ্ছে জনগণের অর্থে। গত তিন বছরে সরকারি ছয় ব্যাংকে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে সাত হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থের জোগান দেয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংকে, যার পরিমাণ দুই হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। আর বেসিক ব্যাংকে দেয়া হয়েছে দুই হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতির দায় জনগণ কেন বছরের পর বছর বহন করবে?


নানা ঘটনা-বিঘটনাদৃষ্টে এমনটি বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন এক দুষ্টগ্রহের শিকার। এই দুষ্টগ্রহ থেকে আমাদের ব্যাংক খাত কবে মুক্তি পাবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। তবে যেসব ঘটনা যেভাবে ঘটছে এবং এর হোতারা যেভাবে এখনো নিরাপদ বলয়েই বসবাস করছে, তাতে মনে হয় সহজে এ থেকে আমাদের মুক্তি নেই। কারণ, এদের ক্ষমতার শিকড় মনে হয় অনেক গভীরে প্রোথিত। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট আয়োজিত এক কর্মশিবিরে বক্তারা একটি মূল্যবান কথা উচ্চারণ করেছেন। তারা বলেছেন, ব্যাংক খাতের দুর্নীতি রোধে প্রধান বাধা শীর্ষ মহল। এ খাতে শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ অনিয়ম রোধে যত পরিদর্শন হয়, শেষ পর্যন্ত এই পরিদর্শকদের টুঁটি চেপে ধরা হয়। ভালো পরিদর্শকদের পদোন্নতি হয় না। এ ধরনের লক্ষণ ব্যাংখ খাতের
জন্য অশনিসঙ্কেতÑ এই যদি হয় অবস্থা, তবে আমাদের যাওয়ার জায়গা থাকে কোথায়?

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/206985