১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১১:৪৫

ঋণখেলাপিদের সেবা দিতে ব্যাংকের আয় কমছে

খেলাপির ৮৭ ভাগই আদায় অযোগ্য; পৌনে এক লাখ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ

তারা ব্যাংকের খাতায় মন্দ মানের ঋণ খেলাপি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছেন না। ব্যাংক মামলাও করেছে। কিন্তু বছরের পর বছর এ মামলা চলছে; নিষ্পত্তি হচ্ছে না। প্রতি বছরই পুরনো ঋণের সাথে সুদ যোগ হচ্ছে। ফলে বাড়ছে পুঞ্জীভূত মন্দ মানের ঋণ। আর ব্যাংকের আয় দিয়ে এ মন্দ ঋণের প্রভিশণ সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। ডিসেম্বর শেষে প্রায় পৌন এক লাখ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে ব্যাংকগুলোর। এ ভাবে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের নিট আয়। ব্যাংকের আয় কমে যাওয়ায় অনেক ব্যাংকেরই নিট লোকসান বেড়ে গেছে। ঋণ মুষ্টিমেয় কিছু ঋণখেলাপির কাছে আটকে যাওয়ায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে ব্যাংক ঋণ। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেশির ভাগ ব্যাংক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের পরিবর্তে বড় অঙ্কের ঋণ দিতে ব্যস্ত। বলা চলে ব্যাংকের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালক ব্যবসায়ী। আবার তাদের কেউ আইন প্রণেতাও। আইনের বেড়াজালে পড়ে নিজ ব্যাংক থেকে বাড়তি ঋণ নিতে পারেন না। ফলে যোগসাজশ করে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়া করায় ঋণের একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে ব্যাংক পরিচালকদের পকেটে। আর যেটুকু থাকছে তারো বড় একটি অংশ যাচ্ছে সুবিধাভোগীদের কাছে। ফলে ব্যাংকের ঋণ এক দিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে, অপর দিকে তা আদায় না হওয়ায় মন্দ ঋণে পরিণত হচ্ছে। আর মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের আয়। আয় কমায় সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদেরকে কাক্সিক্ষত হারে মুনাফা বিতরণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। গত এক বছর ঋণ পরিশোধ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে খেলাপি করা যায়নি। এর ফলে প্রায় সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হওয়ার আগের স্তরে রয়েছে। এর পরেও খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এ খেলাপি ঋণের মধ্যে ৭৬ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকাই মন্দ মানের খেলাপি ঋণ। যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৭ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ রয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলোতে। আলোচ্য ব্যাংকগুলোতে মোট খেলাপি ঋণ হয়েছে ৩৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা, এর মধ্যে ৩২ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকাই মন্দ মানের খেলাপি ঋণ। যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় সাড়ে ৯২ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ রয়েছে সাড়ে ৮২ শতাংশ। আর বিদেশী ব্যাংকগুলোর সাড়ে ৯১ শতাংশ মন্দ মানের খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের বাইরে আবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ রয়েছে আরো প্রায় অর্ধলাখ কোটি টাকা। মন্দ মানের খেলাপি ঋণ তিন বছরের বেশি সময় থাকলে ওই ঋণখেলাপি ঋণের খাতা থেকে আলাদা করে রাখা হয়। যা ব্যাংকিং ভাষায় অবলোপন বলা হয়।

ব্যাংকাররা জানিযেছেন, অনেক বড় বড় গ্রুপ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছেন না। আবার তাদের ঋণখেলাপিও বলা যাবে না। কারণ, ঋণখেলাপি হলে আর নতুন করে ঋণ নিতে পারেন না। নানা প্রভাব খাটিয়ে তারা বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করেও কগজে-কলমে নিজেদের ক্লিন রাখছেন। কেউ ডাউন পেমেন্ট না দিয়ে ঋণ নবায়ন করছেন। কেউবা কাগজে-কলমে পরিশোধ দেখিয়ে ঋণ নিয়মিত রাখছেন। এভাবে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াল হয়ে যাচ্ছে। আবার যে টুকু খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে তার মধ্যে প্রায় ৮৭ ভাগই মন্দ ঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ আদায় হয় না। আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেই মন্দ ঋণের পরিমাণ বেশি ছিল। সেই তুলনায় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে কম ছিল। কিন্তু এখন সরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ যে ঋণ একবার খেলাপি হচ্ছে ওই ঋণ আর সহজেই আদায় হচ্ছে না। ফলে তাদের মন্দ ঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আয় কমে যাচ্ছে। কারণ মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকগুলোর আয় খাতের অর্থ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ডিসেম্বর শেষে মন্দ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো ৬৩ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে। যদিও প্রকৃত পক্ষে সংরক্ষণ করার কথা ছিল ৬৩ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। এর বাইরে সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। একই সাথে কমে যাচ্ছে বিনিয়োগ সক্ষমতা। কারণ আমানতের অর্থ ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়। কম হারে আমানত নিয়ে বেশি মুনাফায় ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণ আদায় না হলেও শর্তানুযায়ী নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সুদে আসলে আমানতকারীদের পরিশোধ করতে হয়। এভাবে এখন অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ আদায় না হওয়ায় নতুন আমানতের অর্থ থেকে মেয়াদপূর্তির আমানত পরিশোধ করতে হচ্ছে। যেখানে ঋণ আদায় হলে ব্যাংকগুলো বেশি হারে বিনিয়োগ করতে পারত। এভাবেই ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে না ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মুনাফা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকগুলোকে কঠিন মূল্য দিতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/562844/