মানুষের আগ্রাসনে দূষণ বাড়ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে। বন-সংলগ্ন এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপন, বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকার এবং নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটনের কারণে ঘটছে এসব দূষণ। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের গাছপালা, বন্যপ্রাণী ও জলজপ্রাণীর ওপর। তবে এ নিয়ে এখনও পূর্ণাঙ্গ কোনো গবেষণা করেনি বন বিভাগ, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো সংস্থা। এমন অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে সুন্দরবন দিবস। ২০০১ সাল থেকে সুন্দরবন সংলগ্ন জেলাগুলোতে বেসরকারিভাবে পালিত হয়ে আসছে দিনটি।
এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তন ও উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন কারণে বেড়েছে নদীভাঙন ও পলি পড়ার হার। তার ওপর মানুষের অবিবেচক কর্মকাণ্ডে দূষণ বাড়ছে সুন্দরবনে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সুন্দরবন সংশ্নিষ্টরা।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করলেও সেই এলাকার মধ্যে গড়ে উঠছে শিল্প প্রতিষ্ঠান। গত ৮-১০ বছরে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, এলপি গ্যাস প্লান্ট, অয়েল রিফাইনারি, বিটুমিন, সি ফুড প্রসেসিং ফ্যাক্টরি প্রভৃতি। বনের খুব কাছেই বিশালাকৃতির খাদ্যগুদাম নির্মাণ করেছে খাদ্য বিভাগ। বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পশুর নদে, যা চলে যাচ্ছে বনের মধ্যে নদী ও মাটিতে।
দীর্ঘদিন ধরে মোংলা বন্দর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বনের মধ্য দিয়ে ১৩১ কিলোমিটার নদীপথে দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচল করছে। বনের মধ্যে নদী দিয়ে রায়মঙ্গল ও কয়রার আংটিহারা এলাকা দিয়ে জাহাজ যাওয়া-আসা করছে ভারতে। মোংলা বন্দরের পশুর নদের চ্যানেলে প্রতিবছর আসছে গড়ে প্রায় সাড়ে চারশ বিদেশি জাহাজ। এ ছাড়া নদে চলাচল করছে পণ্যবাহী কয়েক হাজার দেশি জাহাজ। এসব জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ, হাইড্রোলিক হর্ন ও রাতে আলো আতঙ্কিত করে তুলছে বন্যপ্রাণীদের। নৌযান থেকে নিঃসৃত তেল ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে বনের মধ্যে। এতে দূষিত হচ্ছে বনের মাটি ও পানি। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস তেল নিয়ে ট্যাঙ্কার ডুবির কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে সুন্দরবন। এরপর সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীতে পটাশ সার, কয়লা ও ক্লিঙ্কার বোঝাই জাহাজডুবি হয়েছে আরও ছয়-সাতবার।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ২০১০ সালে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্যতম বড় নদ পশুর নদের প্রতি লিটার পানিতে তেলের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮-তে। অথচ এর স্বাভাবিক মাত্রা ১০ মিলিগ্রাম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদের পানি ও মাটিতে দূষণ বেড়েছে। সে কারণে অনেক স্থানে আগের মতো গাছের চারা গজাচ্ছে না। এ ছাড়া নদের পানিতে তেলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজপ্রাণী। তিনি বলেন, যেসব রুটে নৌযান চলাচল করে, ওই রুটগুলোর বনের পাশে এখন আর তেমন হরিণ, বানরসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী দেখা যায় না।
অভিযোগ রয়েছে, সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিন ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি চক্র। এর ফলে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া, সাপসহ জলজপ্রাণী মারা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে পাচারের উদ্দেশ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে বাঘ ও কুমির।
প্রতিবছর সুন্দরবন ভ্রমণে যাচ্ছেন অসংখ্য পর্যটক। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেছিলেন এক লাখ ৭৩ হাজার পর্যটক। কিন্তু সচেতনতার অভাবে অনেক পর্যটক চিপসের প্যাকেট, পলিথিন, পানি ও কোমল পানীয়ের বোতল, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ, খাবারের প্যাকেট, ওয়ানটাইম প্লেট ও গ্লাস ফেলছেন বনের মধ্যে মাটি ও নদীতে। এ ছাড়া উচ্চ শব্দে গান বাজানো হচ্ছে পর্যটকবাহী কিছু কিছু জলযানে। বনের মধ্যে বুঝে কিংবা না বুঝে হৈচৈ করেন কিছু পর্যটক। এর সবকিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের ওপর।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদাত বলেন, দূষণ রোধে বন বিভাগকেই দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির সমকালকে বলেন, বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে বন বিভাগের উদ্যোগ পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনার সমন্বয়কারী এম বাবুল হাওলাদার সমকালকে বলেন, বনের ইসিএ এলাকায় স্থাপিত অনেক শিল্প কারখানা ও বনের মধ্য দিয়ে জলযান চলার কারণে সুন্দরবনে দূষণ বেড়েছে। দূষণের কারণে এর জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়লেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। এ ব্যাপারে খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান সমকালকে বলেন, বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে দূষণ না করার জন্য পর্যটকদের সচেতন করা হয় প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে বনের দূষণ রোধে বন বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আযম ডেভিড বলেন, ট্যুর গাইডরা সুন্দরবনের মধ্যে পর্যটকরা কী করতে পারবেন, কী করতে পারবেন না, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।