১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১১:১০

চাল-তেলে নাভিশ্বাস

চালের বাজারে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। বাজারে আসা নতুন চালের পাাশাপাশি আমদানি করা চালও প্রভাব ফেলতে পারছে না বাজারগুলোতে। এ ছাড়া সরকারের চাল মজুত কার্যক্রমেও ধীরগতি চলছে। অন্যদিকে লাগাম টানা যাচ্ছে না সয়াবিন তেলের দামেও। সপ্তাহের ব্যবধানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তেলের দাম। এভাবে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পরেও মূল্যস্ফীতি কমে ৫.০২ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানুয়ারি মাসের প্রতিবেদনে দাবি করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। গত বছর জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫.৫৭ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.২৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের বাজারে রেকর্ড তেলের দাম ও চালের ঊর্ধ্বগতি ক্রেতাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। তেলের বাজারের টালমাটাল অবস্থায় অনেকটা দিশাহারা সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, চালের ঊর্ধ্বমুখী বাজার নিয়ন্ত্রণে দেড় মাস আগে দেয়া হয় আমদানির অনুমতি কমানো হয় শুল্ক। বিদেশ থেকে দেশের বাজারে আসতেও শুরু করেছে সেই চাল। তারপরও কমেনি বরং দেশি চালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম বাড়ছে আমদানি করা চালের দামও।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম কিছুটা কমার জন্য চালের যে সরবরাহ দরকার ছিল তা হয়নি। দেশি চালের ওপর চাপ থাকায় দাম বাড়তিই রয়ে গেছে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার বাবুবাজার ও বাদামতলী এলাকার পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা জানান, কিছুদিন আগে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৫৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৬০ টাকা ৫০ পয়সা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬১ টাকা ৫০ পয়সা। নাজিরশাইল চালের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬১ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৭ টাকায়। বিআর-২৮ চালের দাম ছিল ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪৯ থেকে ৫০ টাকা।

পুরান ঢাকার আড়তদাররা চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করেন। মেসার্স ফরিদ রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক মোশারফ হোসেন জানান, বাজারে মিনিকেট চাল তৈরির ধানের মজুত শেষ পর্যায়ে। এ ধান মূলত বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয়। বাজারে মিনিকেট ধানের দাম বেশি থাকায় চালের দাম বাড়ছে। ভারত থেকে চাল আমদানি হওয়ার পরও দামে কোনো প্রভাব পড়েনি বলে জানান তিনি।

এদিকে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে। নাজিরশাইল কিনতে কেজি প্রতি গুনতে হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা। প্রতিকেজি পাইজাম চালের দাম ৫০ টাকা। আর আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা কেজি। এছাড়া স্বর্ণা চাল ৪৮ টাকা, পোলাওয়ের চাল ১০০ টাকা কেজি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি গুদামে চালের মোট মজুত রয়েছে ৫ লাখ ২৭ হাজার টন। গত রোববার পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার টন। আর বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি হয়েছে ৬৮ হাজার টন। তাদের হিসাব মতে, পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি মোটা চাল ৪১ থেকে ৪২ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৪৫ থেকে ৪৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সেদ্ধ চাল বিক্রি হয়েছে ৩৮৫ থেকে ৫৩০ ডলারে। এ দামের চাল দেশে পৌঁছানোর পর প্রতিকেজি দাম পড়ে ৩৫ টাকা ৩৫ পয়সা থেকে ৪৯ টাকা ১৯ পয়সা।

এদিকে এবার বোরো মওসুমে সরকার যে পরিমাণ ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল তা পূরণ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২৭শে ডিসেম্বর চালের আমদানি শুল্ক ৬২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এর ফলে ১২ই জানুয়ারি থেকে স্বল্পমাত্রায় ভারতীয় চাল বাংলাদেশে আসতে শুরু করে।
তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে পরিমাণ চাল আসার প্রয়োজন ছিল, ভারত থেকে সেই পরিমাণ চাল আসেনি বলে বিক্রেতাদের দাবি।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি সরু চাল বিক্রি হয়েছে ৫৮ থেকে ৬২ টাকা। মাঝারি মানের প্রতি কেজি চাল বিক্রি হয় ৫২ থেকে ৫৬ টাকায়। আর মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৪ থেকে ৫০ টাকায়।

বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। এর মধ্যে ছিল মজুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজি রোধ, মিল মালিকদের মজুতের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া, সব শ্রেণির ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠকের মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ প্রভৃতি। তবে এতকিছুর পরও দাম নিয়ন্ত্রণে না আসায় আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কমানো হয় আমদানি শুল্ক। এখন আমদানি শুরু হলেও দাম কমেনি।

কাওরান বাজারের চাটখিল রাইস এজেন্সির পরিচালক বিল্লাহ হোসেন বলেন, দেশীয় চালের দাম অনেক বাড়তি। পরিস্থিতি সামাল দিতে চাল আমদানির খবর ছড়ালেও আমদানি করা চাল বাজারে দেখা যায়নি। ফলে দেশীয় চালের দামও আর কমেনি।

জানা গেছে, ৩২০টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১০ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এদের অধিকাংশই নির্ধারিত সময়ে চাল দেশে আনতে পারেনি। আগামী ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে চাল আমদানির এলসি খুলতে না পারলে অনুমোদন বাতিল করা হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে মন্ত্রণালয়।
চালের বাজারের এমন অবস্থায় অসন্তোষ নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে। রিকশাচালক আয়নাল মিয়া বলেন, ভাড়া ৫ টাকা বেশি চাইলে তো কেউ দেয় না। বাজারে সব সময় কোনো না কোনো জিনিসের দাম বেশি থাকেই। চালের দাম বেশি থাকলে হয় ক্যামনে?

এদিকে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দামও ঊর্ধ্বমুখী বেশ কিছুদিন ধরে। রাজধানীর বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে আরো এক দফা বেড়েছে সব ধরনের ভোজ্য তেলের দাম। বোতলজাত, খোলা সয়াবিনসহ খোলা পাম অয়েলের দামও বেড়েছে। টিসিবি হিসাবেই গত এক সপ্তাহে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে ২.১৯ শতাংশ। খোলা পাম ওয়েলের দাম বেড়েছে ১.২ শতাংশ। আর ৫ লিটার সয়াবিনের দাম বেড়েছে ১.৬৮ শতাংশ। বাজারে দেখা গেছে, লিটারপ্রতি যে ভোজ্য তেলের দাম এক বছর আগে ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিলিটার সয়াবিনের দাম বেড়েছে ২ টাকা করে। গত সপ্তাহে ৫ লিটারের বোতলের দাম ছিল ৬২০ টাকা। এই সপ্তাহে সেই সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৬৩০ টাকায়। অর্থাৎ ৫ লিটারের বোতলে দাম বেড়েছে ১০ টাকা। প্রসঙ্গত, দুই সপ্তাহ আগে ৬০০ টাকায় পাওয়া যেত এই সয়াবিন। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ লিটারের বোতলের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। এছাড়া এখন ১ লিটার বোতল ১৪০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। যদিও কয়েক মাস আগে এই তেলের দাম ছিল ১০৫ টাকা।

ক্রেতারা জানান, বরাবরের মতো এবারও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পরিকল্পিতভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। বাজারে সপ্তাহে সপ্তাহে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। দেখা গেল, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকার সংশ্লিষ্টদের বৈঠকের পর দাম কমতে শুরু করবে। কিন্তু যে পরিমাণে দাম বেড়েছে, সে পরিমাণে কমানো হয়নি। তাই রোজার আগে বাজারের দিকে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে।

কাওরান বাজারে আসা ক্রেতা মাইদুল ইসলাম বলেন, এই ছোট্ট জীবনে সয়াবিনের দাম এতটা বৃদ্ধি হওয়া আগে কখনো দেখি নাই। শুধু সয়াবিনের দামই নয়, অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মাহমুদ রানা বলেন, এক লিটার সয়াবিন তেল ১৪০ টাকা! ভাবা যায়? একবার চাল, একবার পিয়াজ, এবার তেল।

সিএনজিচালক কালাম বলেন, সরকারের তো দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সমস্যা যখন চরমে পৌঁছায় তখন তারা এটা নিয়ে কথা বলে। সমাধান করতে করতে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এভাবে তো চলে না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বাজার নজরদারির জন্য আমরা সব সময় বলে আসছি; কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। কী কারণে দাম বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, অযৌক্তিক মুনাফা করতে ব্যবসায়ীরা সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়ায়। এ প্রবণতা ভোক্তা কিংবা সরকার কারও জন্যই শুভ নয়। তাই এখন থেকে বাজার গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তদারকি করা উচিত।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=262726