২৭ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ১:২৪

সুশাসন কি নির্বাসনে?

দেখা অদেখা

সালাহউদ্দিন বাবর :
দেশে অনিয়ম, অনাচার, অরাজকতা, ক্ষমতার অবৈধ চর্চা, লুণ্ঠন, খুন, জখম, শিশু ও নারী ধর্ষণ, নকল, ভেজালসহ নানা দুরাচার ও দুর্নীতি চলছে অপ্রতিহতভাবে। এসব নিরোধের ক্ষেত্রে আইনকানুন রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু তার সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। দোষীদের বিচারে সোপর্দ করার ঘটনা সচরাচর লক্ষ করা যায় না। এতে সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে। নাগরিকদের জীবনে শান্তি ও স্বস্তি হারিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যা সর্বব্যাপী। এর সমাধানও খুব সহজ নয়। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার তো বটেই, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে আরো বেশি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের এ জন্য কাজ করতে হবে। তা ছাড়া শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় নেতা, পেশাজীবী, প্রভাবশালী মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। সংবাদমাধ্যমগুলোকেও এ জন্য জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে এবং সুশাসনের অভাবে যে জনদুর্ভোগ তা তুলে ধরতে হবে। লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের লেখা ও চিন্তার দ্বারা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে সঙ্কট রয়েছে, সে সম্পর্কে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সিপিএ নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। আইনে সবার সমান আশ্রয় লাভের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে অনেক আইন প্রণয়ন করা হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সবার জন্য সমান অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করাই বড় চ্যালেঞ্জ। কমিউনিটি লিগ্যাল সার্ভিসেস কর্মসূচি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্পিকার এ কথা বলেন।
তার বক্তব্য থেকে এটাই প্রমাণ হয়, বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত নয়। তাহলে হতাশা থেকে এ কথা বলার অবকাশ রয়েছে যে, সুশাসন কি অন্তরীণ না নির্বাসনে?

‘সুশাসন’ বলতে আসলে কী বোঝায়? ‘সু’ শব্দের অর্থ ভালো উত্তম উৎকৃষ্ট সুন্দর শুভ ইত্যাদি। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত থাকলে ন্যায়নীতি অনুসারে উত্তমরূপে, সুষ্ঠুভাবে এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেশ, রাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে। একটি কাক্সিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলনই হলো সুশাসন। সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসনকে সুশাসন বলা যায়। শাসিতের কাম্য শুধু শাসন নয়, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসনÑ যাকে সুশাসন বলা যেতে পারে। কোনো দেশে সুশাসন রয়েছে কি না তা বোঝার জন্য প্রথমে দেখতে হবে, সে দেশে শাসক বা সরকারের জবাবদিহিতা আছে কি না এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আছে কি না। সুশাসন একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে কাক্সিত উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। সুশাসনকে একপ্রকার মানদণ্ডও বলা যায়, যে মানদণ্ডের সাহায্যে একটি রাষ্ট্র বা সমাজের সামগ্রিক অবস্থা যাচাই করা যায়। যে রাষ্ট্র বা সমাজ যত বেশি সুশাসন দ্বারা পরিচালিত, সেই রাষ্ট্র বা সমাজ তত বেশি অগ্রগতির দিকে ধাবিত হয়। বিশ্বব্যাংকের ধারণা সূত্রে, সুশাসন এখানে বর্ণিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করে। যেমন, সরকারি কাজের দক্ষতা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, বৈধ চুক্তির প্রয়োগ, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, স্বাধীন সরকারি নিরীক্ষা, প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধতা, আইন ও মানবাধিকার সংরক্ষণ, বহুমুখী সাংগঠনিক কাঠামো এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সুশাসন তখনই নিশ্চিত হবে যখন সরকারের সিদ্ধান্ত ও কাজগুলো জনগণের আশা-আকাক্সা পূরণে সহায়ক হয়। সরকার জনগণের কাছে তার কর্মের জন্য দায়ী থাকে। সুশাসন আইনের শাসন নিশ্চিত করে। এ ছাড়া এটি রাষ্ট্র বা সমাজে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগণ্যতাকে প্রাধান্য দেয়। উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাতে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পায়। রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে সরকারি খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুশাসন শুধু রাষ্ট্র বা সরকার নয়Ñ বেসরকারি খাত ও সুশীলসমাজকে গুরুত্ব দেয়। অপর দিকে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে সুশীলসমাজের ভূমিকা বিরাট।

এখন দেখা যেতে পারে, সুশাসনের ক্ষেত্রে এ দেশের বাস্তব চিত্রটা কী? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, জাতীয় জীবনে সুশাসনের বিষয়টি নিয়ে তেমন কারো কোনো ভাবনা নেই। অথচ দেশের নাগরিকের ভালো-মন্দ নির্ভর করে যথার্থ সুশাসন বর্তমান থাকার ওপর। দেশের প্রতিটি সরকার এবং ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলো ধারাবাহিকভাবে এ কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। সুশাসনের ধারাবাহিকতা এবং উৎকর্ষ যেন নির্বিঘœ হয়। তখনই সে দেশ কল্যাণকামী একটি দেশে পরিণত হবে। ফলে জনগণের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তি বেশি আসবে। যদি এই মানদণ্ডে বাংলাদেশকে বিচার করা হয়, তবে দেখা যাবে এ ক্ষেত্রে দেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সুশাসনের ধারণাই এখানে পরিষ্কার নয়। ষোল কোটি মানুষের এই দেশ কল্যাণকামী রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজটি কঠিন বটে, কিন্তু শুরুই যে হয়নি এর উদ্যোগ।

দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা এবং যোগ্যতা জরুরি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও এই বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে খোদ বিচার বিভাগের অসন্তুষ্টি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, তাদের সংবিধান অনুসারে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। এর সাধারণ অর্থ হলো, সংবিধান বিচার বিভাগকে যে স্বাধীনতা এবং কর্মপরিধি নির্ধারণ করে দিয়েছে, এর চর্চায় তারা বাধা পাচ্ছেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী কাজ করতে পারলে দেশে দুর্নীতি, অপরাধপ্রবণতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থাকবে না। যখন কোনো রাজনৈতিক সরকার শাসনযন্ত্র ঠিকমতো পরিচালনা করবে না, তখন বিচার বিভাগ এগিয়ে আসবে। না হলে দেশের সভ্যতা থাকবে না।’এর আগে প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি সংক্রান্ত মামলার শুনানিকালে বলেছেন, “বিচার বিভাগকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট জারি না করায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে সরকারপক্ষ আরো সময় চাইলে আদালত বলেন, দেশে কি কোনো সরকার রয়েছে? বিধিমালার গেজেট জারি করতে আর কত দিন সময় প্রয়োজন? রাষ্ট্রের তো একটা ‘ফেয়ার প্লে’র বিষয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটা যৌক্তিক কারণ থাকবে তো।”

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে সুশাসন থাকতে হবে। গণতন্ত্র নিয়ে নানা অভিযোগ ও সঙ্কট বহু দিনের। দেশে এখন যে বিষয় নিয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক তুঙ্গে, তা হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে বহুবার এ নিয়ে আন্দোলন করেছে। কিন্তু গণতন্ত্র অর্জন করা যায়নি। গণতন্ত্র হলো রাষ্ট্রশাসন বা পরিচালনায় কারা সরকারে যাবে, তাদের বাছাইয়ের একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়া এবং জনমত বিচার করার পদ্ধতি। এই প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি কিভাবে অবাধ সুষ্ঠু হতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। সে ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য ও উত্তম হতে হবে। এই উত্তম ব্যবস্থাটাই সুশাসন। সুশাসনের সাথে জড়িত আছে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পরিচালনা, কার্যকর করা এবং নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্র পরিচালনা, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং সংসদে তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচিত সরকারের। সে কারণে সুশাসন এবং দায়িত্বশীল সরকার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর অর্থ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার কর্তৃক জবাবদিহিতামূলক শাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। রাজনৈতিকভাবে সঙ্ঘবদ্ধ সমাজ এবং রাষ্ট্রের হৃদকেন্দ্রে রয়েছে সুশাসন। যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো, সুশাসনের অবর্তমানে তা সেগুলো এখন কার্যকর নেই।

এখন সব মহলেই উন্নয়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। যদিও এটা স্পষ্ট নয়, এ কথা বলে ঠিক কী বোঝানো হয়। এক পক্ষে রাজনীতিক রয়েছেন, পত্রিকার কলামিস্ট রয়েছেন। তারা বলেন, উন্নয়ন মানে প্রবৃদ্ধি। কিন্তু প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টনও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ কথাও বলা হচ্ছে। এই দুই পক্ষের তর্কবিতর্ক থেকেই হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক, একটি ব্যাপারে সবার মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে যে, সুশাসন ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় সে উন্নয়নের সুফল মোটামুটি সবার কাছে অর্থপূর্ণভাবে পৌঁছে দেয়া। জাতিসঙ্ঘে কর্মরত একজন অর্থনীতিবিদ উন্নয়নের জন্য সুশাসন নামে একটি বই লিখেছেন। এই অর্থনীতিবিদের মোদ্দাকথা, উন্নয়নের অধিকাংশ সূচকে বাংলাদেশ বিগত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অর্জন করেছে। কিন্তু এই উন্নয়নকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নেয়া সম্ভব হতো, যদি তার সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হতো। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত থাকলে দেশ আরো এগিয়ে যেতে পারত। আর সে জন্য দরকার গোটাকয়েক কাঠামোগত পরিবর্তন। সুশাসনের দুটো দিক, তার এক দিকে দেশের জনগণ, যারা দেশের প্রকৃত মালিক; অন্য দিকে সরকার ও আমলাতন্ত্র। যারা দেশের মানুষের নামে দেশ শাসন করে। সরকার ও আমলাতন্ত্র যদি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে, তাহলে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান জন্মে এবং তাদের মাঝে দেখা দেয় বিরোধ। আর এই বিরোধের কারণটি স্পষ্ট। সরকার নির্বাচিত হোক অথবা ওপর থেকে জুড়ে বসা হোক, যখন দেশের মানুষের স্বার্থ বিবেচনা না করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে, তখন জনরোষ তৈরি হয় এবং প্রতিবাদ ওঠে জনগণ থেকে। ফলে দেখা যায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এর ঢেউ লাগে অর্থনীতিতে। বিঘœ ঘটে জনগণের দৈনন্দিন জীবনে।

উন্নয়ন আর দুর্নীতি যেন পাশাপাশি চলে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থের প্রবাহ সৃষ্টি হয়। এ সময় সুশাসনের অভাবে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। অথচ এ দেশে দুর্নীতি দমনে সফলতা খুব বেশি নয়। তবে সম্প্রতি দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন তৎপর হয়ে উঠেছে। ফলে দুর্নীতিবাজরা কিছুটা শঙ্কিত। আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের দুর্নীতির পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। বাংলাদেশে দুর্নীতি কোন পর্যায়ে রয়েছে তার একটা উদাহরণ পেশ করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের জন্য উচ্চ আদালতের রুল জারি করা হয়েছে। সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৪ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম স্থানে ছিল।

সম্প্রতি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছে ৮১০ কোটি টাকা। এত বড় দুর্ঘটনার পরও কর্তৃপক্ষের হাবভাবে মনে হয় যেন কিছ্ ুহয়নি। এ ব্যাপারে যে তদন্ত হয়েছে তার প্রতিবেদনও আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। সুশাসনের অভাবে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে এই ঘটনার মূল হোতা। সরকারি নীতিনির্ধারকদের কারো মুখে এখন আর রিজার্ভ চুরি প্রসঙ্গ আসছে না। রহস্যজনকভাবে নীরব রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়। বারবার টালবাহানা করে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। অথচ বহু আগে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশেই নয়, কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা এই প্রথম। এই অর্থের একটা অংশ ফেরত পাওয়া গেলেও বাকি বৃহৎ অংশ ফেরত পাওয়ার উদ্যোগ আর লক্ষ করা যাচ্ছে না। দেশে অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতিও সামাল দিতে পারছে না সরকার। সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রদত্ত ঋণের একটি বিরাট অংশই এখন কুঋণে পরিণত হয়েছে। এসব ব্যাংক জনগণের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কিন্তু কোনো প্রতিবিধান আছে বলে মনে হয় না। দেশের নদ-নদীর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সর্বত্র পানির অভাব। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এ ইস্যুতে মানববন্ধনের আয়োজন করে। সেখানে বিভিন্ন বক্তা বলেন, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি বাংলাদেশের পানি খাতে সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। তারা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পানি ও বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
সম্প্রতি দেশে ‘ভোক্তা অধিকার দিবস’ পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন ছাড়াও সংবাদমাধ্যমে এ উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ ও প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। এসব নিবন্ধ ও প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, নকল আর ভেজালে ছেয়ে গেছে দেশ। সব খাদ্যেই ভেজাল, সব কিছুতেই নকল। শিশুখাদ্য বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু এগুলো নকল ও ভেজালে ভরা। দেশে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সঙ্কট প্রকট। এমনকি, কোনো খাদ্যে ভেজালের এই হার শত ভাগ; কোনোটার তুলনামূলক কম হলেও তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অর্থাৎ, পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে ভোক্তা অধিকার, অপর দিকে কমছে পণ্যের মান। ছোট হচ্ছে আকার, আবার দাম নেয়া হচ্ছে বেশি। এভাবে ঠকছেন ক্রেতা ও ভোক্তা। মুনাফা লুটছে অসাধু ব্যবসায়ী, উৎপাদক ও মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী। পরিমাণে কম দিয়ে দাম বেশি নিয়েও নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের গ্যারান্টি মিলছে না কোথাও। বিপন্ন হচ্ছে মানবজীবন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এর বাস্তবতা ধরা পড়েছে খোদ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারে। ৪৩টি খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব পণ্যের পাঁচ হাজার ৩৯৬টি নমুনার মধ্যে ৪০ শতাংশ নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত ও ভয়াবহ ভেজালের উপস্থিতি। আইনত নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নির্বিঘেœ বাজারে ছাড়া হচ্ছে নানা ধরনের নি¤œমানের ওষুধ। পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, আয়রনসহ বিভিন্ন ওষুধের নামে দেশের বাজারে গোপনে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ওষুধ সদৃশপণ্য। নি¤œমানের ওষুধ প্রস্তুতকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু ওষুধ উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হলেও এ ক্ষেত্রে সুশাসন তেমন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। বেড়েছে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণসহ অপহরণের ঘটনা। এগুলোর মধ্যে কিছু ঘটনা প্রকাশ হলেও বেশির ভাগ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। প্রভাবশালী মহল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাপ এবং লোকলজ্জার কারণে বেশির ভাগ ঘটনা প্রকাশ পায় না। নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানির পর তাদের হত্যা করার ঘটনা ঘটছে। যৌতুকের কারণে নানাভাবে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, অপহরণ, মানবপাচার এবং পর্নোগ্রাফি দ্বারা নির্যাতন করা হচ্ছে। নারী নির্যাতনের ধরন পাল্টানোর পাশাপাশি এর হিংস্রতাও দিন দিন বাড়ছে। বিশেষত মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে এর ভয়াবহতা আরো বেশি। ২০১৬ সালে মোট নারী নির্যাতনের মধ্যে মেয়েশিশুদের ওপর নির্যাতনের হার ২০ শতাংশ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে দু’টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, পৃথিবীর মধ্যে সমস্যাজর্জরিত একটি শহর। এই শহরের সুষ্ঠু পরিচালনা এবং সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দু’জন মেয়র রয়েছেন এই করপোরেশনের। পৃথিবীর বৃহৎ শহরগুলোর কোনোটিতেই দু’জন মেয়র নেই। কিন্তু এখানে দু’জন মেয়র দেয়া হয়েছে সুষ্ঠুভাবে সংস্থাটি পরিচালনার জন্য। অথচ জীবন যাপনের মানের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট শহরের তালিকায় ফের স্থান পেয়েছে ঢাকা। বিশ্বের ২৩০টি শহরের মধ্যে বসবাসের দিক দিয়ে ঢাকা ২১৪ নম্বরে রয়েছে। এবার গত বছরের তুলনায় আরো দশ ধাপ পিছিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক পরামর্শ সেবাদানকারী সংস্থা মার্সারের করা ‘এইটিনথ কোয়ালিটি অব লাইফ র্যাং কিং’ শীর্ষক তালিকায় এটা উঠে এসেছে। জনমতের ভিত্তিতে সুখী দেশ হিসেবেও অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্কের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-২০১৭-এর প্রতিবেদনে ১৫০টির বেশি দেশের মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১০। বিশ্বে সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে নরওয়ে।

আইন নিজ হাতে তুলে নেয়া সুশাসনের জন্য বড় ধরনের বাধা। কিন্তু এটা এখন হরদম হচ্ছে। বিশেষ করে শাসকদলের মূল সংগঠন এবং তাদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রতিদিন আসছে। এখানে অতি সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনা তুলে ধরা হলো। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল ‘বিজয় একাত্তর হল’। এখানে আবাসিক শিক্ষার্থীদের হলে তোলা, সিট বণ্টন এবং শাস্তি দেয়ার মতো কাজগুলো পরিচালিত হয় প্রশাসনের মাধ্যমে। কিন্তু প্রশাসনের কাছ থেকে এই কাজগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সম্প্রতি হলে তুলকালাম কাণ্ড বাধায়।

প্রশাসনকে পাশ কাটিয়ে ছাত্রলীগ নেতারা নিজেরাই হলের বিভিন্ন কক্ষে ছাত্রদের তুলে দেন। আবাসিক শিক্ষকেরা এতে বাধা দিলে তাদের ধাওয়া করা হয়। হলের প্রভোস্টের সম্মুখেই তার কক্ষ ভাঙচুর করা হলো। সাংবাদিকেরা দায়িত্ব পালনকালে কর্মীদের হাতে নাজেহাল হন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/206986