১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১১:০৬

করোনার মলিনতা কাটিয়ে বসন্তবরণকে ঘিরে ফুল ব্যবসায় গতি আনার প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের

ভাষার মাস, ফাগুণের মাস, ঋতুরাজ বসন্তের মাস ফেব্রুয়ারি। এ মাসের শুরু থেকেই উৎসবের আগমনী বার্তা দেয় প্রকৃতিজুড়ে। শীতের জড়তা কাটিয়ে প্রকৃতিও তার যৌবন নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ফাল্গুনের দ্বারপ্রান্তে। কুঁড়িগুলো চোখ মেলে চাইছে, ডালে ডালে কুহু রবে ডাকছে কোকিল। আবেগে আপ্লুত মন যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ফাগুনরাঙা দিনকে বরণ করে নেওয়ার জন্য। উৎসবের এই মাসে তাই ফুল ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। ফেব্রুয়ারিতে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এই এক মাসেই ১৪ থেকে ১৫ কোটি টাকার ব্যবসা করেন সারাদেশের ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মহামারি করোনা উৎসবের দিকেও চোখ রাঙাচ্ছে। করোনায় ঘরবন্দি মানুষের বাইরে বের হওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের মনেও নানা হিসাব-নিকাশ ঘুরপাক খাচ্ছে। তবুও করোনার মলিনতা কাটিয়ে বসন্তবরণকে ঘিরে ফুল ব্যবসায় গতি আনার প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের।

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত এক বছর বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়লেও এবার বসন্তবরণকে ঘিরে ভালো ব্যবসার আশা করছেন ফুল ব্যবসায়ীরা। ফাল্গুন মাস আসার প্রায় চার-পাঁচদিন আগে থেকেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে ফুল এনে ডালা ভরে রাখা হয়েছে রাজধানীর ফুলের দোকানে। নানা রকমের মালিকা আর ফুলের রিং তৈরি করতে ব্যস্ত ব্যবসায়ীরা। আজ রোববার পয়লা ফাল্গুন দিয়ে শুরু হবে ঋতুরাজ বসন্তের। বাংলা সনের তারিখে পরিবর্তন আনায় পয়লা ফাল্গুনের দিনে পড়েছে পাশ্চাত্য ঢংয়ের অপসংস্কৃতি ভ্যালেন্টাইন ডে। প্রতিবছর পয়লা ফাল্গুনকে ঘিরে ফুলের ব্যবসা জমজমাট হলেও এবার করোনাভাইরাসের কারণে উৎসব পালনে স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা আছে। এরপরও ফুলের বাণিজ্য জমে উঠবে বলেই আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

গতকাল শনিবার ঢাকার শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর আগাম প্রস্তুতি দেখা গেছে। দোকানগুলোতে থরে থরে সাজানো হয়েছে নানা রকম ফুলের সাজি। বানানো হচ্ছে মেয়েদের মাথায় পরার ফুলের রিংসহ হাত ও গলার হার। সবমিলিয়ে ফুলের ঘাটতি নেই দোকানে। ক্রেতার ঘাটতি হবে না বলেও মনে করছেন দোকানিরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের ফাল্গুনের দিন তাদের কাছে ভিন্ন। প্রতি বছর এ মৌসুমে ফুলের ব্যবসা ভাল হলেও এ বছর করোনার কারণে ক্রেতা সংকট আছে। তাই আয়োজন অন্যবারের চেয়ে কম। তবুও প্রস্তুতিতে ঘাটতি রাখছেন না তারা।

পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবসে ফুলের দাম কেমন থাকতে পারে জানতে চাইলে শাহবাগ ফ্রেশ ফ্লাওয়ার হাউজের আবু জাফর জানান, প্রতিটি দেশি গোলাপের দাম ২০ থেকে ৫০ টাকা, জারবেরা ৩০ থেকে ৪০ টাকা, গ্লাডিওলাস ২০ টাকা ও রজনীগন্ধা ১০-১৫ টাকা, জুঁই-বেলী মালা ৫০ টাকা, গাঁদা ফুলের মালা ৬০-৭০ টাকা, লিলি ২০০ টাকা, থাই-চায়না ও ইন্ডিয়ান গোলাপ ৮০ থেকে ১০০ টাকা, অর্কিড ৮০ টাকা, কিসিমসিমা মিম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, জারবেরা ৪০ টাকা, গ্লাডিয়াস ৪০ টাকা, ক্যালনডুলা ২০ টাকা, জিপসি ৫০ টাকা পর্যন্ত থাকবে। এসব ফুলের সিংহভাগই আসে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী থেকে। দেশে ফুলের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও দেশের বাইরে চায়না, ভারত, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে ফুল আমদানি করা হয়ে থাকে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

গতকাল শনিবার শাহবাগের ফুটপাতে বসে একদল নারীকে এসব রিংসহ ফুলের বিভিন্ন উপহার তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা গেছে। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে তারা বিভিন্ন ফুলের দোকানের হয়ে এই কাজ করেন।

ব্যবসায়ী ও চাষিদের দাবি, দেশে গত বছরের মার্চে করোনার প্রকোপ শুরু হলে ফুলের ব্যবসায় স্থবিরতা নেমে আসে। কোথাও কোথাও বিক্রি শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। অনেক ফুল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি ঘিরে আবার ফুলের বিক্রি জমজমাট হয়ে উঠেছে। তারপরও অন্যান্য বছর ফেব্রুয়ারি মাসে যে পরিমাণ ফুল বিক্রি হয়, এবার তার অর্ধেকেও হবে না। আবার ফুলের দামও কম।

গাজীপুরের ফুল চাষি দেলোয়ার হোসেন জানান, আমি প্রায় পাঁচ বিঘা জমিতে গোলাপ ও জারবেরা চাষ করেছি। করোনার কারণে গত বছর আমাদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়। গত তিন-চার দিন ধরে বাজার কিছুটা ভালো। আশা করছি এই ফেব্রুয়ারি মাসে আমার ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হবে। আমি নিজে গিয়ে প্রতিদিন ঢাকার শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে ফুল বিক্রি করি। এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫ লাখ টাকার মতো ফুল বিক্রি করেছিলাম। ব্যবসা অনেক ভালো ছিল। ফুলের দামও ভালো পেয়েছিলাম। কিন্তু করোনা শুরু হলে বিক্রি এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। ফুলের চাহিদা আবার বাড়ছে।

নরসিংদীর সুবহান এগ্রো পার্কের মালিক শেখ সেলিম আহমেদ জানান, স্বাভাবিক সময়ে আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে যে পরিমাণ ফুল বিক্রি করি, এবার তার অর্ধেকের মতো বিক্রি হবে বলে আশা করছি। গত ৮-১০ মাস যেখানে শূন্য বিক্রি ছিল, সেখানে অর্ধেক ব্যবসা করতে পারা খারাপ নয়। চাহিদা তো রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। আশাবাদী, ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

যশোরের ফুল ব্যবসায়ী আলী আশরাফ জানান, গত এক বছর আমাদের ব্যবসা খুব খারাপ গেছে। এক সপ্তাহ ধরে বাজার কিছুটা ভালো। আশা করছি ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাজার ভালো থাকবে। এখন ফুলের দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম পাচ্ছি। আশা করছি ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে। ফেব্রুয়ারি মাসেই ৫-৭ কোটি টাকার ব্যবসা হবে।

শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, করোনা যখন থেকে শুরু হয়েছে, আজ পর্যন্ত আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের তেমন বাড়তি প্রস্তুতি নেই। কারণ আমাদের ব্যবসা-বাণিজের টাকা-পয়সা শেষ হয়ে গেছে। যখন করোনা ছিল না, তখন আমরা ফুল কালেকশন করে কোল্ড স্টোরেজ (মজুদ) করতাম। এ বছর আমরা কিছুই করিনি। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে করোনা ছিল না। যে কারণে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই আমরা ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার ব্যবসা করেছি। এবার এক কোটি টাকার ব্যবসাও হবে না। শাহবাগে আমাদের ৫১টি দোকান আছে, এর মধ্যে ৩৫টি দোকানই বন্ধ। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আমাদের বেচা-কেনা তেমন একটা হয়নি। সে কারণে এবার ১৪ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বাড়তি প্রস্তুতি নেই।

তবে বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে হাট জমলেও কাক্সিক্ষত দাম পাননি ফুলের রাজ্য ঝিকরগাছার চাষিরা। তারা বলছেন, এ বছর তারা ফুল প্রতি তিন থেকে পাঁচ টাকা কম দাম পাচ্ছেন। এছাড়া স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় ফুল ঠিকঠাক মতো বিক্রি নিয়েও সংশয়ে রয়েছেন তারা। ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলছেন, চাহিদা না থাকায় এবার বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে গত চার দিনে মাত্র পাঁচ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে।

ব্যবসায়ী ও চাষিরা জানান, বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ফুলের বাজার শুরু হয়। গত শুক্রবার ছিল সবচেয়ে বড় বাজার। ভোর থেকেই বাজারে গোলাপ, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনি, ভুট্টা কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকা, জিপসিসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল নিয়ে গদখালীর ফুলের হাটে হাজির হন চাষিরা। পর্যাপ্ত ফুল ওঠায় জমে ওঠে হাট। এ হাটে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা বেলা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফুল কেনেন। চাষিরা জানান, গত বছর এসময় প্রতি পিস গোলাপ ১৫ থেকে ১৬ টাকা ও অন্যান্য ফুলও উচ্চদামে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু গত শুক্রবার শুরুতে ১০-১১টাকা করে প্রতি পিস ফুল বিক্রি করেছি। পরে ৯ টাকা করেও বিক্রি করেছি। তবে এ বছর দাম তার থেকে কম। করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এ অবস্থা।

ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী আমিনুর রহমান জানান, বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে প্রস্তুতিটা ভালোই ছিল। আশা করছিলাম, এ বছর গোলাপের দাম ১৫ টাকা করে পাবো। কিন্তু দাম তিন-চার টাকা করে কম পাইছি।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম দাবি করেন, চাহিদা না থাকায় এ বছর বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে ফুলের কাক্সিক্ষত দাম পাওয়া যায়নি। করোনার কারণে সারাদেশে সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ, স্কুল-কলেজ বন্ধ। এ কারণে ফুলের চাহিদাও কম। আমরা সরকারের কাছে দাবি রাখতে চাই- সম্ভাবনাময় দেড় হাজার কোটি টাকার ফুলের বাজার রক্ষা ও সম্প্রসারণ করতে সারাদেশে সামাজিক অনুষ্ঠান সীমিত আকারে চালুর রাষ্ট্রীয় ঘোষণা দিতে হবে। এছাড়া বিদেশ থেকে প্লাস্টিক ফুল আমদানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

https://dailysangram.com/post/443744