১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১১:০৩

স্থানীয় নির্বাচনেও আস্থা ফেরাতে পারেনি ইসি

ইতোমধ্যে একে একে তিন ধাপে ১৪৬টি পৌরসভায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই সাথে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও জনগণের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন, ফেরাতে পারেনি আস্থা, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে খোদ ইসি থেকেই বলা হচ্ছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সকল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি ইসি। ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের চিত্রও দেখায় যায়নি নির্বাচনে। এসব নির্বাচনের ফলাফলের অধিকাংশ বিজয়ই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ঘরেই উঠেছে। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৪৬টি পৌরসভা নির্বাচনে ১০৮টিতেই বিজয়ী হয়েছে সরাসরি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী, আর আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে ১৩জন। সেখানে দেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দল বিএনপি বিজয়ী হয়েছে মাত্র ৯টি পৌরসভায়। আর স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলগুলোর প্রার্থীরা ১৬টিতে তাদের বিজয় পেয়েছে। এদিকে নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে চট্টগ্রাম সিটির ভোট। সহিংসতায় কয়েকজনের প্রাণহানি হলেও বিজয়ী হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এমন কী বিএনপির কোন কাউন্সিলর প্রার্থীও বিজয়ী হতে পারেনি। এ নির্বাচনে ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোট পড়েছে। অবশ্য পৌরসভা ভোটগুলোতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন। সেই ধারাবাহিকতায় আজ রোববার চতুর্থ ধাপের ৫৫টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট চলবে। এসব পৌরসভায় ভোটগ্রহণের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ধাপে প্রায় অর্ধেক পৌরসভায় ব্যালট পেপারে এবং অর্ধেক পৌরসভায় ইভিএমে ভোট হবে।

জানা গেছে, এ নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণের জন্য ৫০১ জন নির্বাহী ও ৫৫ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে থাকছেন। পুলিশের ১৬৭টি মোবাইল ও ৫৫টি স্ট্রাইকিং ফোর্স টিম, ১৬৭টি র‌্যাবের টিম, প্রত্যেক পৌরসভায় গড়ে দুই প্লাটুন বিজিবি ও উপকূলীয় এলাকায় প্রতি পৌরসভায় এক প্লাটুন কোস্টগার্ড মোতায়েন করা হয়েছে।

এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি পৌরসভায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে অতিরিক্ত র‌্যাব ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। চতুর্থ ধাপে নির্বাচনের জন্য ৫৬টি পৌরসভার তফসিল ঘোষণা করে ইসি। পরে সোনাইমুড়ি ও ত্রিশাল পৌরসভা এ ধাপে যুক্ত হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের আদেশে নাটোর পৌরসভার নির্বাচন স্থগিত করা হয়। ফেনীর পরশুরাম পৌরসভায় সব পদে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ায় এখানে ভোটের প্রয়োজন হবে না। জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভা নির্বাচন কার্যক্রম বন্ধের পর ফের তা চালু হয়। এছাড়া সহিংস ঘটনায় মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভার ভোট স্থগিত করে ইসি। এজন্য সব মিলিয়ে ৫৫টিতে ভোট হচ্ছে আজ।

যেসব পৌরসভায় আজ ভোট হবে সেগুলো হলো: ঠাকুরগাঁও সদর ও রাণীশংকৈল; রাজশাহীর নওহাটা, গোদাগাড়ী ও তাহেরপুর; লালমনিরহাট সদর ও পাটগ্রাম, নরসিংদী সদর ও মাধবদী, রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ, বরিশালের মুলাদী ও বানারীপাড়া, শেরপুর সদর ও শীবরদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, নাটোর সদর ও বড়াইগ্রাম, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, বান্দরবান সদর, বাগেরহাট সদর, সাতক্ষীরা সদর। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, কুমিল্লার হোমনা ও দাউদকান্দি, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও পটিয়া, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, হোসেনপুর ও করিমগঞ্জ, টাঙ্গাইলের গোপালপুর ও কালিহাতী, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও আলমডাঙ্গা, ফেনীর পরশুরাম, চাঁদপুরের কচুয়া ও ফরিদগঞ্জ, নেত্রকোনা সদর, যশোরের চৌগাছা ও বাঘারপাড়া, রাঙ্গামাটি সদর, মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম, শরীয়তপুরের ডামুড্যা, জামালপুরের মেলান্দহ, ময়মনসিংহের ফুলপুর, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর ও কালাই, নোয়াখালীর চাটখিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, ফরিদপুরের নগরকান্দা এবং সিলেটের কানাইঘাট পৌরসভায়।

প্রথম ধাপের তফসিলে ২৩ পৌরসভায় ইভিএমে ভোট হয় ২৮ ডিসেম্বর। ১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপের ভোট হয় ৬০ পৌরসভায় । তৃতীয় ধাপে ৬২ পৌরসভায় ভোট হয় ৩০ জানুয়ারি। পঞ্চম ধাপের ভোট হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি।

চট্টগ্রামের ভোট নিয়ে বর্তমান সরকার নির্বাচনকে ‘ভোট ডাকাতির কালচারে’ পরিণত করেছে মন্তব্য করেছে বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভোট ডাকাতির ইতিহাস আবারও উন্মোচিত করেছে আওয়ামী লীগ।

বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে কোনো নির্বাচন হয়নি, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের নির্বাচন আওয়ামী লীগের সাথে হয়নি, হয়েছে আওয়ামী প্রশাসন, আওয়ামী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সাথে।

চট্টগ্রামের ভোট নিয়ে উত্তপ্ত হয় সংসদও। সংসদে একটি খসড়া আইন পাসের সময় বিএনপি সাংসদ হারুনুর রশীদ চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, সংবিধানে বলা আছে সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রশাসন চালাবেন। কিন্তু আজ কী হচ্ছে? নির্বাচনের নামে তামাশা হচ্ছে। প্রহসন হচ্ছে। এর প্রয়োজন নেই তো। ভোটের প্রয়োজন নেই, আইন করে নির্বাহী ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রী যাকে খুশি মনোনয়ন দেবেন। তিনি নির্বাচিত হবেন। সকালে দেখলাম, চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনে কী হচ্ছে।

এরপর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আমরা এখানে যারা আছি, গতকালকে জন্ম নিইনি। উনারা নির্বাচনের কথা বলছেন। আমরা জিয়াউর রহমানের সময় ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দেখেছি। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দেখেছি। ব্যালটবাক্স পাওয়া যেতো না। ভোট যে দেবে, ব্যালট বাক্স নেই। যাদের এই চরিত্র, তাদের কাছ থেকে নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু করতে হয় সেটা শেখার প্রয়োজন নেই। জনগণকে ভোট দেয়ার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছি।

এরপর বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ভোট দেয় প্রশাসন। আর দেখে জনগণ। ভোটটা সুষ্ঠু করে করলেই তো হয়। কারো থেকে ভোট শিখতে হবে না। ভোট কীভাবে দিতে হয় সেটা সবাই জানে। ভোটটা দিতে দিলেই হয়।

‘নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক বলা যায় না’

স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোকে অংশগ্রহণমূলক বলা যায় না বলে অভিমত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের। ২য় ধাপের পৌরসভার ভোট চলাকালে সাভারের তিনটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন তিনি। ওই দিনই সাংবাদিকদের কাছে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, পৌরসভার নির্বাচনে ক্রমাগত সহিংসতা বেড়ে চলেছে। সহিংসতা ও নির্বাচন একসঙ্গে চলতে পারে না। নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন না হলে এই সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সকলের ঐক্যমত্য আবশ্যক। যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে মানুষের জীবন অনেক বেশি মূল্যবান।

ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আলোচিত এই কমিশনার বলেন, তিনটি বুথে আমি তিনজন বিরোধী দলীয় প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দেখতে পাই, কিন্তু অন্য কোথাও এজেন্ট ছিলেন না। এছাড়া সাভার পৌর এলাকায় আমি বিরোধী দলীয় প্রার্থীর কোনো পোস্টার দেখতে পাইনি। এমতাবস্থায়, এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা যায় না। যে কোনো নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে তা সিদ্ধ হয় না।

আর চট্টগ্রাম সিটির ভোট নিয়ে তিনি বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য নির্বাচনী কাঠামো পরিবর্তন দরকার।

https://dailysangram.com/post/443771