১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১২:৫৭

পাটের কৃত্রিম সংকটে শতাধিক মিল বন্ধ

বাজারে চালের দাম তিন বছরের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যকেও দামে টেক্কা দিয়েছে পাট। এক কেজি কাঁচা পাটের দাম এখন প্রায় আড়াই কেজি চালের দামের সমান। পাট বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা কেজি, প্রতি মণ পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। এই দর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবু মিলছে না, তাই দাম বাড়ছে দিন দিন।
এত চড়া দামে পাট কিনে পণ্য উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই একের পর এক বন্ধ হচ্ছে পাটকল। শতাধিক বেসরকারি পাটকল এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও বন্ধের উপক্রম। আর সরকারি সব পাটকল গত বছর মার্চেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

বিশ্নেষকরা মনে করেন, পাটশিল্পের এই ধারা দেশের অর্থনীতিতে নতুন বিপর্যয় ডেকে আনবে। কারণ চাষিসহ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ৪ কোটি মানুষের জীবিকা চলছে পাট ঘিরে।

বেসরকারি খাতের জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) জানায়, শতাধিক পাটকল বন্ধের পাশাপাশি দেড়শ কল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এখনও চালু থাকা মিলগুলো খুব বেশি দিন চালু রাখা সম্ভব হবে না। বিজেএমএ এবং জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) পাটকলের সংখ্যা ছিল ২৯৬। প্রত্যক্ষভাবে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ। এর মধ্যে এক লাখ শ্রমিক এখন বেকার।

পাটকল মালিকদের ভাষ্য, কারসাজি ও মজুদদারির কারণে পাটের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, মৌসুমের শুরুতে অধিক পরিমাণে কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে এবার। পরে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে অনেকে পাট মজুদ করে রেখেছে। তাই বাজারে জোগান কম। ফলে দাম বাড়ছে।

এ বছর পাট উৎপাদন হয়েছে ৭২ লাখ ৮৬ হাজার বেল। আগের বছর তা ছিল ৭৪ লাখ বেল। এ বছর রপ্তানি হয়েছে ৪ লাখ বেল। পাটকলগুলোতে ব্যবহার হয়েছে ৩০ লাখ বেল। গৃহস্থালিতে ব্যবহার হয় প্রায় ৫ লাখ বেল। লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী ও কিছু পাটকল মালিকের হাতে রয়েছে এখন মাত্র ১০ লাখ ৯৪ হাজার ৮২৫ বেল। এ পর্যন্ত মোট ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৯ লাখ ৯৪ হাজার ৮২৫ বেল। মোট উৎপাদন থেকে বাদ দিলে দেশে এখনও প্রায় ২৩ লাখ বেল কাঁচাপাট থাকার কথা। কিন্তু বাজারে পাট নেই। এগুলো বৈধ ও অবৈধ মজুদে আটকা পড়ে আছে।

পাট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হোসেন আলী খোন্দকার সমকালকে বলেন, উদ্যোক্তারা ঠিকই বলছেন। আসলেই কাঁচা পাটের সংকট চলছে। তবে সরকার তৎপর। অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। বাজারে পাটের সরবরাহ বাড়ানো গেলে সংকট নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান থেকে জানা
গেছে, মৌসুমের শুরুতে গত জুলাই মাসে কাঁচা পাটের রপ্তানি আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি হয়েছে। জুলাই-আগস্টে বেশি হয়েছে ৬৭ শতাংশ। পরে তা কমতে থাকে।

প্রথমদিকে অস্বাভাবিক রপ্তানির কারণে দেশে পাটের সংকট শুরু হয়। এর সঙ্গে মজুদদারি যুক্ত হয়ে তা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। এর পর বাংলাদেশে পাটের মূল্য বেশি হওয়ায় রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

পাঁচজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতে দর ছিল দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মণ। সাধারণত ওই সময় পাটকল মালিকরা বছরের মোট চাহিদার একটা বড় অংশ হাট থেকে সংগ্রহ করেন। এ বছর মৌসুম শুরু হওয়ার ঠিক আগে মার্চে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। দাম পড়ে যাবে- এমন ভাবনায় তারা এ বছর হাট থেকে অনেক কম পাট সংগ্রহ করেছেন।

বিজেএমএ সভাপতি মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী সমকালকে জানান, পাট এখন কৃষকের হাতে নেই; ব্যবসায়ী বা মজুদদারদের হাতে। এদের কাছ থেকে এখন মণপ্রতি ৫২০০ টাকায় পাট কিনছেন তারা। দেশের ইতিহাসে কখনও এত বেশি মূল্য ছিল না পাটের। এ দামে পাট কিনে শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ওমরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ সমকালকে বলেন, 'আমাদের পাট- আমরা ঠকলাম। লাভ খাইলো দালালে।'

টনে লোকসান ১৮ হাজার পাটকল মালিকরা জানান, পাটপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের পাটপণ্য। অনেক ক্রেতা বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। ক্রেতা হাতে রাখতে উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে বিক্রি করছেন কোনো কোনো উদ্যোক্তা। তারা জানান, এক টন পাটপণ্যের উৎপাদন ব্যয় এখন এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। রপ্তানি হচ্ছে এক লাখ ১২ হাজার টাকায়। ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি গুনছেন তারা।

দেশে তিন শতাধিক বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন, বিক্রি ও রপ্তানি হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও ভারত পাটের উল্লেখযোগ্য বাজার। তবে পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি পাটপণ্য রপ্তানি হয়। পাটের এ সংকট কাটাতে তাই আমদানির অনুমতি চান উদ্যোক্তারা। দেশে পাট আমদানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চান তারা।

মাওনা জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন সোহেল সমকালকে বলেন, দর কমে আসবে, এ আশায় কম করে পাট কিনেছি। কিন্তু কারসাজির কারণে দিন দিন পাটের দাম বাড়ছেই। পণ্য উৎপাদনের জন্য পাট নেই। অথচ ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পণ্য দিতে হবে। এখন লোকসান গুনে চুক্তি রক্ষা এবং ক্রেতা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। মজুদ পাট বাজারে ছাড়া না হলে আমদানি ছাড়া বিকল্প নেই।

সোহেল জানান, তারা খবর নিয়েছেন, তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দরে ভারত থেকে পাট আমদানি করা সম্ভব। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অবস্থা এখন এমন, নিজেদের রপ্তানি করা পাটই বেশি দামে আবার আমদানি করতে হবে।

এবার ভারতে বিপুল পরিমাণ কাঁচা পাট রপ্তানি ও পাচার হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে এ সংক্রান্ত রপ্তানি তথ্যও উল্লেখ করেন সোহেল।

সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি সংকটের কথা উল্লেখ করে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন উদ্যোক্তারা। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর কাছে প্রথমে চিঠি দিয়ে পরে দেখা করেছেন বিজেএমএ-বিজেএসএ নেতারা। মন্ত্রীকে দেওয়া দুই সংগঠনের চিঠিতে বলা হয়, অতি মুনাফালোভীরা কাঁচা পাট মজুদ করে দাম অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। পাট সংকটের কারণে আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে ৯৫ শতাংশ পাটকল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এ ছাড়া বৈধ লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরাও যাতে ৫০০ মণের বেশি পাট এক মাসের বেশি সময় মজুদ রাখতে না পারে, তা আইন করে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে চিঠিতে।

বেসরকারি সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জম সমকালকে বলেন, কাঁচা পাটের মজুদ পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে তদারক করা দরকার। দর বৃদ্ধি স্বাভাবিক নয়। বাজারে আরও বেশি মজুদ থাকার কথা।

গোলাম মোয়াজ্জম বলেন, সবার আগে পাট ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় মজুদ রোধে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। তিনি মনে করেন, পাট আমদানি করা যেতে পারে। শিল্পে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান অর্থাৎ অর্থনীতির স্বার্থে সীমিত সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ কাঁচা পাট আমদানির অনুমতি দেওয়ার চিন্তা করতে পারে সরকার। তবে খুব সতর্কতার সঙ্গে চাহিদা ও জোগান পর্যবেক্ষণ করেই আমদানির অনুমতি দিতে হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/210252640/