১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১২:৫২

রাষ্ট্রীয় ১৩ প্রতিষ্ঠান

লোকসান তিন হাজার কোটি টাকা

১৮ করপোরেশনের ব্যাংক ঋণ ৩৯৩৪২ কোটি টাকা - রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের

রাষ্ট্রীয় ৩০টি করপোরেশনের মধ্যে ১৮টির কাছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ ৩৯ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। আবার ১৩টি প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন হাজার (দুই হাজার ৯০১ কোটি) টাকা।

এর মধ্যে গত বছর মুনাফায় থাকলেও নতুন ৮টি প্রতিষ্ঠান লোকসানে এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নেওয়া ঋণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশই খেলাপি। অর্থাৎ, ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর পরিশোধ করতে পারছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা’ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে সরকারি করপোরেশনগুলোর ঋণ ব্যবহারে বড় ধরনের দুর্নীতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব, কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় ট্রেড ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ, অধিক জনবল নিয়োগ, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়।

তবে তাদের মতে, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এখানে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলোর দায়দেনা ও লোকসানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কখনোই এই বিষয়টিকে জোরালোভাবে দেখা হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

তিনি বলেন, এসব সংস্থার লোকসান অব্যাহতভাবে বাড়ছে। তারা ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করে না। এদের রাজস্ব দায়বদ্ধতা লাখ লাখ কোটি টাকা। এসব সংস্থাকে কীভাবে লাভজনক করা যায়, সে বিষয়ে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। তিনি বলেন, এ খাতে এত বেশি লোকসান না দিলে টাকাগুলো উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা যেত।

লোকসানি প্রতিষ্ঠান : ১৩টি প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ দুই হাজার ৯০১ কোটি টাকা। এককভাবে সবচেয়ে বেশি লোকসান চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণ এক হাজার ৬১ কোটি টাকা, বিজেএমসির ৭৪২ কোটি, বিসিআইসি ৭২৭ কোটি, বিএফআইডিসি ২২ কোটি, বিটিএমসি ২১ কোটি, ঢাকা ওয়াসা ২৯৩ কোটি, বিআরটিসি ৬৯ কোটি, টিসিবি ৫৫৭ কোটি, খুলনা উন্নয়ন করপোরেশন এক কোটি ৬০ লাখ, বিএফডিসি ১৮ কোটি ৫৬ লাখ, বিআইডব্লিউটিএ ৫৬ কোটি ২২ লাখ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ২৭ কোটি এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্স সেন্টার ৩৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে সরকারি শিল্প করপোরেশন লোকসান দেয়। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, ট্রেড ইউনিয়নের অযাচিত হস্তক্ষেপ, অধিক জনবল নিয়োগ, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, পেশাদারিত্বের অভাব, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা ও অধিক উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্য।

এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, কোম্পানি লাভজনক হওয়ার জন্য উন্নত ব্যবস্থাপনা দরকার। আর ব্যবস্থাপনায় সংকট থাকলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরও কোম্পানি লাভজনক হতে পারবে না। তিনি বলেন, কোনো কোম্পানির হিসাবেও ঝামেলা রয়েছে। কিন্তু কোম্পানি লিস্টেড হলে তার হিসাব স্বচ্ছ থাকে।

অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণ বলছে, এ ধরনের করপোরেশনের ব্যাপারে মানুষের এ ধরনের আস্থা নেই। ফলে আস্থা পুনরুদ্ধার ছাড়া কোম্পানি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম। সংস্থাটি মনে করছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান লাভজনক করতে সরকারের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালনা করতে হবে।

অন্যদিকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন গঠনের পর এ পর্যন্ত ৭৭টি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে এর মধ্যে ৩১টিই বন্ধ। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো : কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিল, সার্ভিস ফ্যাসিলিটিজ সেন্টার, সাতরং টেক্সটাইল মিলস, মেটালেক্স করপোরেশন, ইস্টার্ন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ঢাকা ভেজিটেবল অয়েল, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ মুন্সীগঞ্জ, ফিরোজ আটা ও ডাল মিলস, বিজি বাংলা রাইস মিলস, কর্নফ্লাওয়ার মিলস, দোশা এক্সট্রাকশন, আশরাফিয়া অয়েল মিল, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ খুলনা, বাওয়া জুট মিল, ঈগল বক্স অ্যান্ড কার্টুন, স্কুইব বাংলাদেশ লিমিটেড, কোহিনুর ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারিং, ফিশ এক্সপোর্ট বাজুয়া এবং ম্যানগ্রোভ টেনিন।

যে কারণে লোকসান : ওই সময়ে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের এ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশকিছু কারণে প্রতিষ্ঠান লোকসান হয়। এরমধ্যে রয়েছে-আগের দায়, ব্যাংক ঋণের ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ, শিল্প খাতে সরকারের প্রণোদনার অভাব, গ্যাস বিদ্যুতের অভাব, জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য, দক্ষ জনশক্তির অভাব, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন ও সুযোগ সুবিধায় পার্থক্য, সিবিএর অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া, কখনো কাঁচামালের স্বল্পতা এবং বিএমআরই করার মতো মূলধন না-থাকা। এরপর প্রাইভেটাইজেশন কমিশন ভেঙে অনেক আগেই বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) গঠিত হয়েছে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।

যত ঋণ : অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ কোম্পানির ঋণ ৩৯ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ সাত হাজার ৬৯২ কোটি টাকা, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ছয় হাজার ৪৯২ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পাঁচ হাজার ৫৮৯ কোটি, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ চার হাজার ১০৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন তিন হাজার ১৩৪ কোটি, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) দুই হাজার ২০৬ কোটি, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন এক হাজার ৪১১ কোটি, বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) ৯৩৫ কোটি এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এক হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন থেকে ঋণখেলাপি সেগুলো হলো : বিএডিসি ২১ কোটি, বিটিএমসি ২১ কোটি, বিজেএমসি ১৫ কোটি এবং বিটিবি ১০ কোটি ৫২ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/392791/