তেল ও চালের দাম বেড়েই চলছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কাওরান বাজার থেকে তোলা ছবি -সংগ্রাম
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১২:৪৪

দেশের ইতিহাসে সয়াবিন তেলের দামে রেকর্ড

দেশের ইতিহাসে তেলের দামে রেকর্ড হয়েছে। ২০২০ সালের অগাস্ট পর্যন্ত দেশের বাজারে প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলোর এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১০৫ টাকা। গত পাঁচ মাসে লিটারপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম এখন দাঁড়িয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। এটি দেশের বাজারে তেলের সর্বোচ্চ দাম বলে জানা গেছে। খোলা তেলের দামও লিটারপ্রতি পৌঁছেছে ১২৫ টাকায়। অবশ্য সরকারের বিপণন প্রতিষ্ঠান টিসিবি কার্যক্রমে প্রতি লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার কারণে দেশের ভোজ্য তেল বাজারের এমন টালমাটাল অবস্থা বলে জানিয়েছে দেশের তেল বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো। এ দাম আরও বাড়তে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।

জানা গেছে, করোনাভাইরাস সঙ্কটকালে গত বছরের মে মাসে মেঘনা ও সিটি গ্রুপ তাদের সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা করে কমিয়েছিল। সে সময় এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম নেমে আসে ১০৫ টাকায়, যা গত অগাস্ট পর্যন্ত বজায় ছিল। এরপর থেকে মাসে মাসে বাড়তে থাকে তেলের দাম। ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতি সপ্তাহেই মেঘনা, সিটি গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডসহ সব সয়াবিন তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের তেলের দাম বাড়ছে। গতকাল ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি লিটার ১৪০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাজার ঘুরে দেখা যায়, বোতলজাত সয়াবিন তেলের মধ্যে রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের তেল সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এক লিটার তেলের খুচরা দর ১৪০ টাকা। পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। দুই লিটার তেলের দাম ২৭৫ টাকা। পাইকারি কিনতে গুনতে হচ্ছে ২৫৫ টাকা। আর পাঁচলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল রূপচাঁদা খুচরা বিক্রি করছে ৬৮৫ টাকা দরে। আর পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে ৬৩০ টাকায়। রূপচাঁদার চাইতে কিছুটা কমে বিক্রি হচ্ছে তীর ও এসিআই ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল। তীর ব্র্যান্ডের এক লিটার সয়াবিন তেল খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়। পাইকারি দর ১২৮ টাকা। একই দামে বিক্রি হচ্ছে এসিআই ব্রান্ডের এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল। দুই লিটার তীর সয়াবিন তেলের খুচরা বিক্রি হচ্ছে ২৬৮ টাকায়। পাইকারি দর ২৫২ টাকা। খুচরা বাজারে এসিআই একই দামে দুই লিটার বোতলজাত তেল বিক্রি করলেও পাইকারি বাজারে চার টাকা বেশি নিচ্ছে এসিআই। আর তীরের পাঁচ লিটার তেলের খুচরা দর ৬৫৫ টাকা। পাইকারি বাজারে সে দর ৬২৫ টাকা। এসিআই পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তীরের চাইতে পাঁচ টাকা কমে ৬৫০ টাকায় বিক্রি করছে। তবে পাইকারি বাজারে তীরের চাইতে পাঁচ টাকা বেশি এসিআই কোম্পানির তেলের দাম। বিক্রি হচ্ছে ৬৩০ টাকা দরে।

তেলের বাজারের টালমাটাল অবস্থায় অনেকটা দিশেহারা সাধারণ মানুষ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মাহমুদ সোহেল বলেন, এক লিটার সয়াবিন তেল ১৪০ টাকা! ভাবা যায়? একবার চাল, একবার পেঁয়াজ, এবার তেল। সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয় না। সমস্যা যখন চরমে পৌঁছায় তখন তারা এটা নিয়ে কথা বলে। সমাধান করতে করতে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এভাবে তো চলে না।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি )-এর হিসাবেই গত এক সপ্তাহে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে দুই দশমিক ১৯ শতাংশ। খোলা পাম ওয়েলের দাম বেড়েছে এক দশমিক দুই শতাংশ। আর পাঁচ লিটার সয়াবিনের দাম বেড়েছে এক দশমিক ৬৮ শতাংশ। ডাল, ময়দা, মসলার মতো অন্যান্য নিত্যপণ্য এবং সবজির দামও বাড়ছে।

বাজারের তথ্য বলছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম বেড়েছে দুই টাকা করে। গত সপ্তাহে পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ছিল ৬২০ টাকা। এই সপ্তাহে সেই সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৬৩০ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ লিটারের বোতলে দাম বেড়েছে ১০ টাকা। প্রসঙ্গত, দুই সপ্তাহ আগে ৬০০ টাকায় পাওয়া যেত এই সয়াবিন। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাঁচ লিটারের বোতলের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। এছাড়া এখন এক লিটার বোতল ১৪০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা জীবনে সয়াবিনের দাম এতটা বৃদ্ধি হওয়ার ঘটনা দেখেননি। তবে শুধু সয়াবিনের দামই নয়, অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে আদা, ময়দা, হলুদ, তেজপাতাও। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে আমদানি করা আদা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। ৩৬ টাকা কেজি খোলা ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকা দরে। ১৭০ টাকা কেজি হলুদ এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা দরে। ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া তেজপাতা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা। ১৩০ টাকা কেজি ধনে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। এছাড়াও দাম বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির। এদিকে টিসিবির হিসাবে, গত এক সপ্তাহে হলুদের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। তেজপাতার দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ এবং ধনের দাম বেড়েছে ২১ শতাংশ।

এর বাইরে মসুর ডাল ও অ্যাংকর ডালের দামও কিছুটা বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, সবজির বাজারও ধীরে ধীরে অস্থির হচ্ছে। বাজারের তথ্য বলছে, চালের দাম এখনও রয়েছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। গরিবের মোটা চালের দাম এখনও ৪৬ টাকা থেকে ৫০ টাকা কেজি। চিকন বা সরু চালের কেজি এখন ৬২ থেকে ৬৫ টাকা। আর মাঝারি আকারের চালের দাম প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। সব মিলিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সীমিত আয়ের মানুষদের জন্য নিত্যপণ্য কেনাও যেন এখন কঠিন ব্যাপার। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি।

তবে দাম কমেছে পেঁয়াজের। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা, যা গত সপ্তাহে এক লাফে ৪০ টাকায় উঠেছিল। তার আগে পেঁয়াজের কেজি ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুচরার পাশাপাশি পাইকারিতেও সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কমেছে। গত সপ্তাহে ১৭৫ টাকা পাল্লা বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ এখন ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে পাইকারিতে এক কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ছে ২৫ থেকে ২৭ টাকা। এদিকে পেঁয়াজের পাশাপাশি আলু ও ডিমের দামও কিছুটা কমেছে। খুচরা বাজারে এক কেজি নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৮ টাকা, যা গত সপ্তাহে ২০ টাকায় উঠেছিল। আর গত সপ্তাহে ১০০ টাকা ডজন বিক্রি হওয়া ডিমের দাম কিছুটা কমে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে গত সপ্তাহের মতো পাকা টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। শসার কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৪০ টাকা। মুলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা, বেগুনের কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, পেঁপের কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, গাজরের কেজি ১৫ থেকে ২৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের মতো ফুলকপি ও বাঁধাকপির পিস বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। তবে লাউ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা পিস, যা আগের সপ্তাহে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা।

এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ডিম, ব্রয়লার মুরগী ও সোনালি মুরগির দাম। প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা, হাঁসের ডিম ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা, দেশি মুরগির ডিমের ডজন ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা। এছাড়া দাম বেড়ে সোনালি মুরগি (কক) বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি দরে। কিছুদিন আগেও ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগি এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি মুলা ১০-১৫ টাকা, টমেটো ও গাজর ৩০ টাকা, শালগম ২৫ থেকে ৩০ টাকা, শিম ৩০ থেকে ৪০ টাকা, একই দামে বিক্রি হচ্ছে বেগুন, ঢেঁড়স, পাকা টমেটো। ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে করলা ও বরবটি। আকারভেদে লাউ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা প্রতি পিস। ১০ থেকে ১৫ টাকা পিস হিসেবে মিলছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি। মিষ্টি কুমরার কেজি ৩০ টাকা, চিচিংগা ৩০ থেকে ৪০ টাকা, কাঁচাকলা ১৫ থেকে ২০ টাকা হালি, কাঁচা মরিচ ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

গরুর গোস্ত প্রতি কেজি আগের মতোই ৫৫০ টাকা ও মহিষের গোস্ত ৫৫০ থেকে ৫৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খাসি ও বকরির গোস্ত ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে পাওয়া যাচ্ছে। মাছের বাজারে রুই মাছ আকারভেদে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, মাগুর মাছ ৫০০-৬০০ টাকা, শিং মাছ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়, মৃগেল ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, পাঙ্গাস ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। চিংড়ি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, বোয়াল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, কাতল ১৫০-২৮০ টাকা, ফোলি ৩০০-৪০০ টাকা, পাবদা ১৫০-২৫০ টাকা, টেংরা ১৬০-২২০ টাকা, তেলাপিয়া ১৪০ টাকা, সিলভার কাপ ১০০-১৫০ টাকা, দেশি কৈ ১৫০ থেকে ৬০০ টাকা, কাঁচকি ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, আইড় মাছ ৫০০, রিডা ২২০ টাকা ও কোরাল ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, রূপচাঁদা কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মাছের রাজা ইলিশ এখন কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে হাজার টাকায়।

https://dailysangram.com/post/443631