একদিকে মাদকবিরোধী অভিযান, অন্যদিকে অভিনব কৌশলে চলছে মাদক আমদানি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যেই নিত্যনতুন কৌশলে প্রতিদিন মাদক আসছে রাজধানীতে। রেলপথ, সড়ক পথ ও নৌপথে সক্রিয় মাদক কারবারীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে কখনো যাত্রী, কাঁচামাল ব্যবসায়ী ও গাড়িচালক সেজে ফেনসিডিল এবং ইয়াবার চালান আনা হচ্ছে।
মিয়ানমার তৈরি করছে ইয়াবা আর ভারত তৈরি করছে ফেনসিডিল। আর সেবন করছে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ। ফলে ভারত আর মিয়ানমার এ দেশের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর মাদকের ছোবলে আক্রান্ত হচ্ছে যুব সমাজ। পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সবজি পরিবহনে বিশেষ চেম্বার তৈরি, শুকনো মরিচ, জুতা, ইলিশ মাছ, কচ্ছপ ও নারীদের অন্তর্বাসসহ নানা কিছুর ভেতর ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক পাচার করে আসছে মাদক ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীতে বেড়েই চলছে মাদকের আমদানি। এমনই একটি চালানের ১১০০ বোতল ফেনসিডিলসহ দুই মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ। গ্রেপ্তাকৃতরা হলো- নুরে আলম ওরফে লিটন মোড়ল (৪৯) ও ড্রাইভার মো. সুজন হোসেন (৩০। এসময় তাদের কাছ থেকে ফেনসিডিল বহনে ব্যবহৃত একটি আলু-সবজি ভর্তি ট্রাক জব্দ করা হয়। গতকাল শুক্রবার গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো.মাহবুবুল বলেন, বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ১০টায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার শহীদ তাজ উদ্দিন আহমেদ সরণি এনার্জি প্যাক ইলেকট্রনিক্স এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা কখনও আলু কখনও সবজি ভর্তি ট্রাকের মাধ্যমে অভিনব কায়দায় অবৈধ মাদকদ্রব্য ফেনসিডিলের চালান ঢাকায় নিয়ে আসতো। এই চালানটি জয়পুরহাট জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। এ সংক্রান্তে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, এই চক্রটি বস্তা ভর্তি করে ফেনসিডিল আনে। পরে আলুর বস্তাও সঙ্গে নেয়। ফেনসিডিল ও আলুভর্তি বস্তা একসঙ্গে ঢাকায় নিয়ে আসে। তারা বলেছে, ফেনসিডিল নির্দিষ্ট কারাবারােিদর কাছে পৌঁছে দেয়। পরে আলু কারওয়ানবাজারে বিক্রি করে দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে তারা আলুর বস্তার সাথে কৌশলে ফেনসিডিলের বস্তা একসঙ্গে নিয়ে আসছিল।
এর আগে আরেক অভিনব কায়দায় আনা ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা এলাকা থেকে ইয়াবাসহ ২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ওয়ারী বিভাগ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মো. এনামুল হক ও সুমাইয়া আক্তার। অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ খলিলুর রহমান জানান, একটি কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভারের সিটের ভেতরে অভিনব কায়দায় লুকানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ইয়াবাগুলো। এছাড়াও বিমানবন্দর এলাকা থেকেও অভিনব কৌশলে মাদক পাচারকালে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রায়ই স্থল ও সীমান্তসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদক জব্দ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইয়াবাই সবচেয়ে বেশি। আর ইয়াবা পাচারে বাহকদের কৌশলে বিস্মিত সংশ্লিষ্টরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিতে মাদক ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে এসব মাদক পাচারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, জিআই পাইপ, পানির কলসিতে ইয়াবা তৈরির কেমিক্যাল, মহিলাদের অন্তর্বাস, ছাতা, ইলিশ মাছ ও শুকনো মরিচও রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, তাকি, বশিরহাট, স্বরূপনগর, ভাদুরিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁও, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রানাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদীয়া, মালদহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট এবং দিনাজপুরে মাদক ঢুকছে। আর ভারতের আসাম এবং মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেঁষা এলাকাগুলোর চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনায়। এছাড়া ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে নওগাঁয় ফেনসিডিল পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব রুট দিয়ে দেশে হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা আসছে। পরে নানা কৌশলে রাজধানীতে ঢুকছে এসব মাদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সঙ্গে মাত্র ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তের সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো গোটা দেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ঢুকছে কোটি-কোটি পিস ইয়াবা। ইয়াবার অবাধ প্রবেশে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বেশিরভাগ ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমার-চীন সীমান্তের শান এবং কাচিন প্রদেশে। মিয়ানমারের সাবাইগন, তমব্রু, মুয়াংডুর মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, ধুমধুমিয়া, কক্সবাজার হাইওয়ে, উখিয়া, কাটাপাহাড়, বালুখালি, বান্দরবানের গুনদুম, নাইখ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার মতো অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। আর হাত বদল হয়ে নানা পন্থায় রাজধানীতে আসছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা।
অপর একটি সূত্র জানায়, দেশর রেলপথে সক্রিয় রয়েছে চোরাকারবারি চক্র। যথাযথ ও পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় চক্রের নারী ও পুরুষ সদস্যরা ট্রেনে যাত্রী সেজে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক পাচার করছে। তারা শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে ইয়াবা-হেরোইন রেখে পাচার করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তব্য, চোরাকারবারিরা বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে রেলপথে মাদক বহন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে। কোনো ট্রেনেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ সদস্য নেই। কোনো স্টেশনেই স্ক্যানার মেশিন নেই। ফলে শত চেষ্টা করেও রেলপথে চোরাচালান পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে রাজধানীতে ইয়াবা, গাঁজা ও ফেনসিডিল পাচারের পরিমাণ বাড়ছে। বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার এবং মাদক ব্যবসায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করার পরেও এদের নিয়ন্ত্রণে আনা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন কৌশলে মাদক পরিবহন করলেও আমরা এ সব কৌশলের সাথে পাল্লা দিয়ে এদের আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি। মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের সবার সহযোগিতায় মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।