১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১২:৩৯

চাল নিয়ে চালবাজি রুখা দরকার

ধানের দেশ আর গানের দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এখানে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, ঘেঁটুগানে যেমন বাঙালির মন মজে; তেমনই বহুপদের সুগন্ধি চালের ভাতে প্রাণ জুড়োয়। সবচালের ভাত সুগন্ধযুক্ত না হলেও স্বাদে চমৎকার। কাটারিভোগ, বিন্নি, বিরোই, বেগুনবিচি, কালাজিরা, নাজিরশাইল, রঘুশাইল, ঝিঙ্গাশাইল, বালাম, দাদখানি, চিনিগুঁড়া, নেনিহা, বাসমতি, বাঁশফুল কতরকম চাল তা এক নিবন্ধে উল্লেখ করা মুশকিল। এসব চালের ভাত বাংলাদেশ, ভারত, চিন, ফিলিপাইন, জাপান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান প্রভৃতি দেশের মানুষের প্রাণ ভরিয়ে তোলে। রসনা তৃপ্ত করে। বাংলাদেশের সবচালই সুন্দর এবং এ সবের ভাতও দারুণ স্বাদের। তবে কাটারিভোগ, চিনিগুঁড়া, কালাজিরা, নেনিহা, বাসমতি চালের ভাত খেতে স্বাদেগন্ধে অতুলনীয়।

পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নওগাঁসহ উত্তরাঞ্চলের প্রখ্যাত কাটারিভোগ চালের নাম কে শোনেননি? এর সুঘ্রাণ এবং স্বাদ ভজনরসিকদের কাছে অতীব প্রিয়। কাটারিভোগ আতপচালের পোলাও, খির, পায়েস, বিরিয়ানিতো বটেই; সেদ্ধ কাটারিভোগ চালের ভাতও দারুণ সুগন্ধময় এবং সুস্বাদু। শুধু তাই নয়, এ ধানের চারা অবস্থায়ও খেত থেকে সুঘ্রাণ বেরোতো। আর এখন? বাজারে “কাটারিভোগ” নামে সীলছাপ্পর মারা বস্তায় যে-চাল পাওয়া যায় তার সেই স্বাদ ও সুঘ্রাণ কোনওটাই নেই। অর্থাৎ একশ্রেণির ব্যবসায়ী প্রতারণার মাধ্যমে কাটারিভোগ চালের সুনাম ব্যবহার করে গ্রাহকদের ঠকাচ্ছেন অনেক দিন থেকেই।
ঢাকাসহ দেশের বাজারে “কাটারিভোগ” নাম দিয়ে সাধারণ চিকন চাল বিক্রি হয়। বস্তায় লেখা থাকে “কাটারিভোগ”। এ চালের ভাতের বিশেষ স্বাদ নেই। সুঘ্রাণ নেই। চাল বেশ সরু এবং খাটো। আসল কাটারিভোগ আরও একটু মোটা এবং লম্বাটে হয়। সেদ্ধ কাটারিভোগ চালের ভাত রান্নার পরও সুঘ্রাণযুক্ত ও দারুণ সুস্বাদু হয়।
এমন প্রতারণার বিষয়টি সম্পর্কে সৎ চালব্যবসায়ীদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

বাজারে কাটারিভোগ চালের বস্তার গায়ে লেখা “প্রিমিয়াম”। এর অর্থ হয় পারিতোষিক, উপহার, দান, অধিহার, লাভ, কিস্তি ইত্যাদি। “প্রিমিয়াম” শব্দের দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা কোনটা বোঝাতে চান, বোধগম্য নয়।

উল্লেখ্য, ঢেঁকিছাটা চালের ভাতে যেস্বাদ পাওয়া যেতো, এখনকার চালকলের চালের ভাতে সেটা নেই। দোষটা কীসের, চালের, চালকলের না চাল-ব্যবসায়ীদের? এর রহস্য উদঘাটন দরকার।

বলে রাখা ভালো, “মিনিকেট” নামে কোনও ধানের চাষ হয় না আমাদের দেশে। তাহলে এ চাল আসে কোত্থেকে এবং কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে: মিনিকেট চাল তৈরি হয় আধুনিক চালের কারখানায়। দেশি জাতের মোটা ধান চালকলে আসবার পর শুরু হয় তেলেসমাতি। প্রথমে ধানের খোসা বা তুষ ছাড়ানো হয়। তুষ ছাড়ালে চালের প্রাকৃতিক রঙ খয়েরি বা বাদামি আভাযুক্ত থাকে। এরপর রাসায়নিক দিয়ে ও হোয়াইটনার মেশিনের মাধ্যমে চালের খয়েরি বা বাদামি আভার আবরণ আলাদা করা হয়। আবরণ সরানোর পর চাল কিছুটা সরু ও সাদা হয়। এখানেই শেষ নয়। পলিশার মেশিনের মাধ্যমে পলিশ করলেই হয়ে যায় মিনিকেট চাল। এ ছাড়া চাল চকচকে করতে মোমের ব্যবহারও করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, মোটা চাল এভাবে প্রসেস করে মিনিকেট বানালে তো ব্যবসায়ীর ক্ষতি। তাহলে ক্ষতির হিসেবটা কষা যাক: এক টন বা ১০০০ কেজি মোটা চাল প্রসেস করে মিনিকেট বানালে সাধারণত চাল পাওয়া যায় ৯৩৩ কেজি। সাদা খুদ ২৬.৫ কেজি, কালো খুদ ১৪ কেজি, মরা চাল ৪.৫ কেজি, ময়লা ০.৭৫ কেজি এবং পলিশ ২৭ কেজি। যোগ করলে দেখা যায় এক টন চাল প্রসেস করবার পর পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৬ কেজি বেশি। বলা আবশ্যক, এ ৬ কেজি হচ্ছে জলীয় বাষ্প ও পানি। রাইসব্রান তেলের কারখানাগুলো পলিশ কিনে নেয়। সাদা খুদ বাজারে চালের অর্ধেক দামে বিক্রি হয়। কালো খুদ আর মরা চাল পশুখাদ্য হিসেবে বিক্রি হয়।
তাহলে চাল প্রসেসের খরচ কত? এক টন মোটা চাল প্রসেস করে মিনিকেট বানাতে খরচ হয় ৯০০ থেকে ১৫০০ টাকা। অর্থাৎ কেজিপ্রতি ৯০ পয়সা থেকে দেড় টাকা।
মোটা চাল প্রসেস করে মিনিকেট বানিয়ে বিক্রেতা একটু বেশি লাভ করলে ক্রেতার ক্ষতিটা কী? ছোট ক্ষতি হচ্ছে, ক্রেতা চিকন চালের দামে মোটা চাল কিনছেন। অর্থাৎ কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত ঠকছেন। বড় ক্ষতি হলো, কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি দিয়ে মিনিকেট চাল নয়, ক্রেতা কিনছেন মোটা চালের আবর্জনা। কারণ, প্রসেস করবার মাধ্যমে চালের ওপরের আবরণ মানে ব্রান অর্থাৎ পেরসিকার্প, সিডকোট, এলারুয়েন লেয়ার, এমব্রাইও প্রভৃতি চালের পুষ্টিকর অংশ বাদ পড়ে যায়। উল্লেখ্য, চালের সর্বমোট ৮৫ ভাগ ভিটামিন বি-৩ থাকে পেরসিকার্পে, প্রোটিন আর ফ্যাট থাকে এলারুয়েন লেয়ারে, খনিজের ৫১ ভাগ ও মোট আঁশের ৮০ ভাগ থাকে ব্রানে, ভিটামিন বি-১ ও ভিটামিন ই থাকে এমব্রাইওতে। চালের সব পুষ্টিকর উপাদান তেলের মিলে বিক্রির জন্য প্রসেস করে আলাদা করবার পর চাল আর চাল থাকে না। হয়ে যায় চালের আবর্জনা।

আর হ্যাঁ, মিনিকেট চাল নামে চালের আবর্জনাকে যতোটা ক্ষতিকর মনে করা হয় বাস্তবে তা আরও বেশি। মোটা চাল মিনিকেটে রূপান্তরিত করবার বিভিন্ন পর্যায়ে সোডিয়াম হাইড্রোক্লোরাইড, এর সঙ্গে টুথপেস্ট এবং এরারুটের মিশ্রণ, সোয়াবিন তেল, ফিটকিরি, বরিক পাউডার ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া প্রতি মৌসুমেই বের হয় নিত্য নতুন কৌশল। মিনিকেট চালে কখনও পোকা ধরে না। কারণ বেচারা পোকাও জানে এ চাল খাবার উপযুক্ত নয়। এতে পুষ্টিগুণ নেই। তাছাড়া মিনিকেট চাল রান্না করলে অন্যান্য চালের মতো ভাত বাড়ে না। দেখতে সুন্দর সাদা ধবধবে এ অখাদ্য বা চালের আবর্জনাই মানুষ বেশি দামে কিনে খাচ্ছে। কিন্তু কোনও পুষ্টিগুণ পাচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখা জরুরি।

একশ্রেণির চালকল মালিকদের বিরুদ্ধে অনেক দিনের অভিযোগ, মোটা ইরি চাল কাটিং মেশিনে কেটে সরুচাল তথা মিনিকেট বানিয়ে বাজারজাত করা হয়। এটাই হচ্ছে চালব্যবসায়ীদের চালবাজি। এমন চালবাজিই চলছে দেশে। এ নিয়ে বহুবার রিপোর্ট হয়েছে। লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু অপকর্মটি বন্ধ করা যায়নি।

মিনিকেট এবং সুঘ্রাণহীন কাটারিভোগ চাল হচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর চালাকি বা প্রতারণা। সাধারণ ইরিচাল মেশিনে কেটেছেটে মিনিকেট এমনকি “কাটারিভোগ” চাল হয়ে যায়। দামও নেয়া হয় বেশি। অনেকে রসিকতা করে বলেন, মেশিনে কাটা হয়তো তাই নাম দেয়া হয়েছে “কাটারিভোগ”। এটাকে সাধারণ চালের কাটারিভোগে রূপান্তরিত হবার প্রক্রিয়া বলা যায় বৈকি।

চালের দাম নিয়েও ব্যবসায়ীরা বারবার চালবাজি করেন। হাজার-বারো শ’ টাকা দরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে গুদামজাত করে রাখা হয়। প্রতি ৪০ কেজি ধানে প্রায় ২৭ কেজি চাল হয়। এ হিসেবে চালের কেজি পড়ে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকার মতো। কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ে চাল বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭০ টাকার মতো। এরপরও নাকি চালে ব্যবসায়ীদের লাভ হয় না।

এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য নিয়ে চালবাজি রুখতে না পারলে চালের দাম অদূর ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। গ্রামের বাজারে যে-দামে ধান বেচাকেনা হয় তাতে চালের কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকার বেশি হবার কথা নয়। অথচ চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি অর্থাৎ প্রায় ডাবল দামে। কিন্তু কেন?

https://dailysangram.com/post/443656