১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:১৬

তিস্তা মহাপ্রকল্পে দিল্লির দেয়াল

মোদির ঢাকা সফরে ঝুলানো হয়েছে ‘পানি চুক্তির মুলা’

আষাঢ়-শ্রাবণে বন্যা-নদী ভাঙন আর শুকনো মৌসুমে ধূ-ধূ মরুভ‚মি-তিস্তা অববাহিকার এমন চিত্র কয়েক দশকের। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারত উজানে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে অবৈধভাবে পানি সরিয়ে নেয়ায় তিস্তা নদীর এই পরিণতি। এতে জীববৈচিত্র্যের বিপন্নতার পাশাপাশি তিস্তা অববাহিকার লাখ লাখ মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে বিপন্ন। উত্তরাঞ্চলের কয়েক লাখ কৃষক পানির অভাবে ধান চাষ করতে পারছেন না। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে বছরের পর বছর দেন-দরবার, আন্দোলনের মুখে ভারত তিস্তা চুক্তি করতে রাজি হয়। এ লক্ষ্যে দেশটির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হলেও ন্যায্য হিস্যা পায়নি বাংলাদেশ।

এই অবস্থায় তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দুই বছরের সমীক্ষায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে বর্ষার পানি ধরে রাখার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। এই মহাপ্রকল্পে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। শিগগিরই দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কাজ শুরুর আশা সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু ক‚টচালে ভারত সে প্রকল্প যাতে হতে না পারে সে লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছে। তিস্তা চুক্তি না করলেও নদীটি নিয়ে বাংলাদেশের মহাপ্রকল্পে দেয়াল দিচ্ছে দিল্লি। এতে করে প্রস্তুতি থাকা সত্তে¡ও প্রকল্পের কাজ শুরুতে বিলম্ব হচ্ছে।

তিস্তার পানির জন্য উজানের দেশ ভারতের কাছে চাতক পাখির মতো প্রতীক্ষা আর নয়। বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর ১১৩ কিলোমিটার অববাহিকার পুরোটাই নেয়া হয়েছে এই মহাপরিকল্পনায়। তিস্তা ড্রেজিং করে কোটি মানুষের দুঃখ ঘুচানো হবে। এ পরিকল্পনায় রয়েছে- ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুইপাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন। চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা। ভারত যুগের পর যুগ ধরে, তিস্তা চুক্তির মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে। চীনের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত পানি আর প্রয়োজন পড়বে না। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। বন্যায় উচলে ভাসাবে না গ্রামগঞ্জ জনপদ। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। নৌবন্দর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুইপাড়ে থানা, কোস্টগার্ড, সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থা প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। গত বছর নভেম্বর ও ডিসেম্বর চীনের চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও সেটি নানা কারণে বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পটির মূল প্রকল্প এখন পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। আগামী ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসবেন, সেখানে আগে তিস্তার পানি চুক্তি হবে। পানি চুক্তি না হলে চীনের প্রক্রিয়া শুরু করবে সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরে তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পটি বাংলাদেশের ২য় প্রকল্প।

জানতে চাইলে তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প পরিচালক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সরকার আগে তিস্তার পানি চুক্তির পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি হয়ে গেলে তার পরে তিস্তা প্রকল্পের জন্য কাজ শুরু করবে। তিস্তায় চীনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে উত্তরাঞ্চলের জেলারগুলোর চিত্র পাল্টে যাবে। তিস্তার নদী খনন, নদীর দু’পাড়ে তীর রক্ষা, চর খনন, দুইপাড়ে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ এবং হাজার হাজার বাড়িঘর রক্ষা পাবে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত পানির আর চুক্তির প্রয়োজন হবে না। দ্রুত এ প্রকল্পের ক্রিয়া শুরু হবে। যমুনা নদী ২৬ কিলোমিটিরজুড়ে চড় সেখানে যদি আমরা ৬ কিলোমিটারে আনতে পারলে অনেক জমি উদ্ধার হবে। সে জমিগুলোতে বড় বড় কাজ করা যাবে।

লাদাখ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে বাংলাদেশ তিস্তা নদীর উপর একটি প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে সফরে আসছেন। কৌশলগত কারণে তার আগে চীনের প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে না। তবে ভারতের সাথে আগে তিস্তার পানি চুক্তি হবে। তার পরে চীনের সঙ্গে সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনার চুক্তি করবে।

তিস্তা চুক্তি দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা নিয়ে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ভারতের পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক শুভজিৎ রায় লিখেছেন, ‘তিস্তার পানি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা এমন সময়ে এসেছে যখন লাদাখ সীমান্ত নিয়ে চীন ও ভারতের বিরোধ চরম পর্যায়ে। বাংলাদেশ ও চীনের আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশে আকস্মিক সফরে যান ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর তিনিই প্রথম বিদেশি অতিথি, যার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখা করেছেন। গত পাঁচ মাসে মহামারি সম্পর্কিত বিষয়ে একে অন্যের পাশে ছিল ভারত ও বাংলাদেশ। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আঞ্চলিক জরুরি তহবিল গঠনের ব্যাপারে মোদির আহ্বানকে সমর্থন জানান শেখ হাসিনা। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জরুরি তহবিলে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার অনুদানের ঘোষণা দেন। গত মাসে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির আওতায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সড়কপথে কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের প্রথম ট্রায়াল রান’ হয়। ভারতীয় বিশ্লেষক জানায়, সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করায় ভারতের কপালে ভাঁজ পড়েছে। ইসলামাবাদ এটিকে কাশ্মীর বিষয়ে কথোপকথন হিসেবে উল্লেখ করলেও বাংলাদেশ বলছে বৈশ্বিক মহামারি করোনা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ব্যাপারে কথা হয়েছে। ভারতের শ্রিংলার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। গত দশকে ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশে ভারতের রফতানির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ০৪ বিলিয়ন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন বলছে, চিকিৎসা, পর্যটন, কর্মস্থল এমনকি শুধু বিনোদনের জন্যও ভারত প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ লাখ বাংলাদেশিদের ভিসা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী হিসেবে বরাবরই সুসম্পর্ক ছিল ভারতের। তবে সীমান্ত হত্যা, আসামের মুসলমানদের তাড়িয়ে দেয়া এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের অযাচিত বক্তব্য এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে।

জানতে চাইলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম ইনকিলাবকে বলেন, তিস্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাপরিকল্পনার নির্মিতব্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ। আমাদের সরকারের আমলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করা হবে। কে বাঁধা দিলো সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয় পায় না।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার ইনকিলাবকে বলেন, পানিসম্পদ থেকে ইআরডিতে পাঠানো হয়েছে। তারা কাজ করছে। আগামীতে যে কোনো সময় চীনের সঙ্গে চুক্তি হবে।
ইআরডির এশিয়া, জেইসি এবং এফএন্ডএফ অনুবিভাগের প্রধান যুগ্মসচিব মো. শাহ্রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী ইনকিলাবকে বলেন, তিস্তা প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে যে কোনো সময় পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।

তিস্তা প্রকল্প তথা বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগে প্রথম থেকেই বাগড়া দিচ্ছে ভারত। মোদির কট্টর হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী নীতির কারণে দেশটি কার্যত একঘরে হয়ে গেছে। তারপরও ভারত চায় দক্ষিণ এশিয়ার ভুরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে নিজের বলয়ে রাখতে। কিন্তু নিজের দেশের অর্থনীতির ত্রাহি অবস্থা, অথচ প্রতিবেশি বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। ভারত প্রতিবেশি এবং বড় অর্থনীতির আস্ফালন দেখালেও বাংলাদেশে দেশটির বিনিয়োগ যৎসামান্যই। এ জন্য দেশটি মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার পুরোনো রেকর্ড বাজাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই সে দেশে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ চীন বিনিয়োগ করেনি। এ অবস্থায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা নদীপাড়ের মানুষ চায় চীনের অর্থায়নে তিস্তা মহাপ্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করা হোক।

https://www.dailyinqilab.com/article/357099/