১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:১২

প্রকল্প বাস্তবায়ন ঢিমেতালে ব্যয় ও সময় বাড়ছে লাফিয়ে

অনুমোদিত ২ বছর ২ মাসে অগ্রগতি মাত্র ৩৮.৭০ শতাংশ; ৪১৭ কোটি টাকা থেকে খরচ এখন ৮২০ কোটি টাকায়; ২৬ মাসের প্রকল্প ঠেকল ৬ বছর ২ মাসে

প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি না থাকলেও খরচ বাড়ানোর ক্ষেত্রে গতিশীলতা বাংলাদেশে বেশি। নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পগুলো শেষ হচ্ছে না। টেনে নেয়া হচ্ছে বছরের পর বছর। একই দশা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের। ২ বছর ২ মাসে যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল সেটি এখন ৬ বছর ২ মাসে উন্নীত হচ্ছে। খরচ ৪১৭ কোটি টাকা থেকে দুই দফায় বাড়িয়ে ৮২০ কোটি টাকায় দাঁড়াচ্ছে। অনুমোদিত দুই বছর ২ মাসে অর্থাৎ ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত অর্থ ব্যয় ও বাস্তবায়নের অগ্রগতি মাত্র ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি যেখানে ২০২০ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল, সময় বাড়িয়েও তার অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। এখন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে করোনাকে বাধা ও জনবল নিয়োগে বিলম্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যানুযায়ী, রাঙ্গামটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিন পার্বত্য এবং দুর্গম এলাকায় শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক সেবা পৌঁছানোর জন্য সমন্বিত উন্নয়নের লক্ষ্যে ইউনিসেফের সহায়তায় পার্বত্য এলাকায় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। উদ্দেশ্য ওই সব এলাকার অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সাম্যতা অর্জনের লক্ষ্যে মৌলিক সেবার সুযোগ এবং মা ও শিশুদের জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। তিন পার্বত্য এলাকার ১২১টি ইউনিয়নের সাড়ে চার হাজার পাড়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি একনেক থেকে অনুমোদন দেয়া হয়। ২০২৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর মাত্র ৮ মাসের ব্যবধানে সাড়ে ৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৪২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও সময় এক বছর বাড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অনুমোদন দেন। প্রকল্পটি চলমান অবস্থাতেই নতুন করে কাজ যুক্ত করা হয়। ৫০০টি নতুন পাড়াকেন্দ্র নির্মাণ, আড়াই হাজারটি পাড়াকেন্দ্র মেরামত, ২৮টি মডেল পাড়াকেন্দ্র স্থাপন, ৩টি গুদাম, ৫০০টি ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ ভেনু নির্মাণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন দ্বিতীয় সংশোধনীতে খরচ বাড়ছে ৯৩.১৭ শতাংশ বা ৩৯৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পের বাস্তবায়ন খরচ ৮২০ কোটি টাকায় প্রস্তাব করা হয়েছে। আর বাস্তবায়ন মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত অর্থাৎ আরো তিন বছর ২ মাস বৃদ্ধি।

প্রকল্পটি সংশোধনের কারণ সম্পর্কে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি ও জনবল নিয়োগের বিলম্বের কারণে প্রকল্পের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। সম্পূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা ও স্থায়িত্ব অর্জনের জন্য ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন। সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজারটি পাড়াকেন্দ্রে পাড়াকর্মী ও মাঠ সংগঠক এবং আবাসিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্টাফদের বকেয়া বেতন প্রদান ও মেয়াদ বৃদ্ধিতে বেতন ভাড়া বৃদ্ধি। নতুন করে কাজ অন্তর্ভুক্ত করায় ব্যয় বরাদ্দ সংশোধন। নতুন করে ৫০৩টি বিভিন্ন ধরনের যানবাহন কেনা।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম প্রধানের পর্যবেক্ষণ হলো, বিভিন্ন খাতে খরচে প্রকল্প সাহায্য বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এবং সহযোগী সংস্থার সম্মতিপত্র বা চুক্তিনামা দাখিল করা হয়নি ডিপিপিতে। প্রকল্পে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ খরচে বরাদ্দ ছিল ২১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। কিন্তু ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৯ লাখ ১৯ হাজার টাকা। এ ছাড়াও অনাবাসিক ভবন নির্মাণ খাতে বরাদ্দ ১২ কোটি ৩ লাখ টাকা। কিন্তু খরচ দেখানো হয়েছে ১২ কোটি ৭৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। বরাদ্দের চেয়ে ব্যয় বেশি করা হয়েছে; যা আর্থিক বিধিবিধানের পরিপন্থী।

এ পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে বোর্ড থেকে জানা গেছে, চার হাজার পাড়াকর্মী, ৪০০ জন মাঠ সংগঠক ও ৩০৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ প্রদান সম্পন্ন। ৪৮ হাজার শিশুর শিশু বিকাশ ও প্রাক-শিক্ষাকার্যক্রম চলমান। চার হাজার পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারীদের পুষ্টি সেবা প্রদান। চার হাজার পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম চলমান। ১০১টি শিশুবান্ধব ল্যাট্রিন, ১৩১টি নিররাপদ পানির উৎস স্থাপনের মাধ্যমে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পানি ও পয়ঃব্যবস্থা উন্নয়নে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন। আধুনিক সুবিধাসংবলিত ২৫টি মডেল পাড়াকেন্দ্রে অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই পাড়াকেন্দ্র স্থাপন।

এক হাজার ৩৪৮টি পাড়াকেন্দ্র মেরামতের কাজ সম্পন্নকরণ। তিন জেলায় ৩টি কিশোর-কিশোরী সম্মেলন আয়োজন। এক হাজার পাড়াকর্মী ও মাঠ সংগঠক এবং ৫০ জন কর্মকর্তার শিশু লালন পালনের ওপর প্রশিক্ষণ। ৩০ জন কর্মকর্তার ও ৪০০ জন মাঠ সংগঠকের স্বল্পমূল্য ও বিনামূল্যের শিক্ষা উপকরণ তৈরিবিষয়ক প্রশিক্ষণ। ৮৫০ জন কিশোরী লিডারের কিশোরীদের পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ। ৩৮৯ জন প্রতিস্থাপিত পাড়াকর্মীর মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান।

এ ছাড়া ৩০ জন কর্মকর্তা ও ৪০০ মাঠ সংগঠকের কেইছ ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক প্রশিক্ষণ। তিন জেলার ডিসিসি সদস্যদের ইসিডি-বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান। ১২টি ডিসিসি, ১০৪টি ইউজেডসিসি ও ৪৮৪টি ইউএনসিসি সভা আয়োজন। ৭৭৫ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রথাগত নেতাদের ইসিডি-বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান। ৮২৫ জন পাড়াকর্মী ও মাঠ সংগঠকের পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান। দুর্যোগকালীন শিক্ষাকার্যক্রম চলমান রাখার নিমিত্ত প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সাথে যৌথভাবে ৭টি কার্যক্রম বাস্তবায়ন।
প্রকল্প পরিচালক ও উপসচিব ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরীর সাথে গতকাল মোবাইল ফোনে প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, বুধবার পিইসি সভায় বেশ কিছু অবজারভেশন দিয়ে আরডিপিপিটি ফেরত পাঠানো হয়েছে। সেগুলোর আলোকে প্রকল্পটি সংশোধন করে আবার পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করতে হবে।

প্রকল্পের সময় ও খরচ বৃদ্ধির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পে কাজের এলাকা ও নতুন করে বেশ কিছু কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এ বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ আছে।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) জাকির হোসেন আকন্দের সাথে গতরাতে মোবাইলে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/562013