১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:১০

খুনীরা গ্রেফতার হয়নি॥ স্বজন ও সহকর্মীরা হতাশ

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার নয় বছর পূর্ণ হলো আজ। এত বছরেও আলোচিত এ হত্যা মামলার প্রকৃত খুনীদের চিহ্নিত করতে পারেনি র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে’ অপরাধী গ্রেফতারে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই আশ্বাসের পর এখন পর্যন্ত তদন্তের জন্য সময় নেয়া হয়েছে ৭৮ বার। এতটি বছরেও কেউ জানে না কারা খুন করেছে কিংবা কেন করেছে। তদন্ত থমকে আছে একই বৃত্তে। শুধু প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পরিবর্তন ছাড়া দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

মামলাটি তদন্ত করছে র‌্যাপিড আ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সম্প্রতি আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয় একটি প্রতিবেদন জমা দেয় র‌্যাব। এরপর আর কোনো অগ্রগতির প্রতিবেদনও দেয়া হয়নি। এরআগে গত চার ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ায় তারিখ ৭৮ বারের মতো পেছানো হয়। পরবর্তী তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য আগামী ১১ মার্চ ধার্য করেছেন আদালত। এদিন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পূর্ব নির্ধারিত দিনে তদন্ত কর্মকর্তা তা জমা না দেয়ায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবদাস চন্দ্র অধিকারী নতুন এ দিন ধার্য করেন।

চাঞ্চল্যকর এই হত্যার ঘটনার অনুসন্ধান করা সাংবাদিকদের অনেকে মনে করেন, তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত কয়েকবছর নীরবতা পালন করায় তদন্ত আরো বেশি ব্যাহত হচ্ছে। এই ঘটনা নিয়ে সেসময় সাংবাদিক সংগঠনগুলো ব্যাপক আন্দোলন করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা স্তিমিত হয়ে যায়। এই ইস্যু নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কার্যকরভাবে চাপ প্রয়োগ করা যায়নি। এ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। তবে শিগগিরই তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। বেডরুম থেকে ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় বাসায় ছিল তাদের একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ। ঘটনাস্থলে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার’ মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। দুই দিন পর তৎকালীন পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। তখন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দুই মাস তদন্তের পর ‘ব্যর্থতা’ জানালে আদালত র‌্যাবকে তদন্তভার দেন। তারা সাত বছর ১০ মাস ধরে তদন্ত করছে।

এই খুনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো ডিএনএ নমুনার পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে মামলার রহস্য উদঘাটন হবে বলে এর আগে র‌্যাবের কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছিলেন। তবে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলেই যে অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব হবে- তেমনটি নাও হতে পারে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, র‌্যাবের ৬৯টি অগ্রগতি প্রতিবেদনেই ‘গুরুত্বসহকারে তদন্ত চলছে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় ২০০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে। সন্দিগ্ধ আসামীদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের নাম ও ঠিকানা যাচাই এবং পূর্ব ইতিহাস জানার জন্য গতিবিধি, চাল-চলন গভীর ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়। ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার কথা বলা হলেও চুরি যাওয়া ল্যাপটপ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে।

২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দাখিল করা এক প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেছে। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুজন পুরুষের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রফাইল পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃত আট আসামী, নিহত দুজন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি। এই মামলায় গ্রেফতারকৃত আটজনের মধ্যে পাঁচজন- ফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীরকে। এদের মধ্যে তানভীর, মিন্টু ও পলাশ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছে। বাকিরা এখনো কারাগারে আছে। মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলম রোমান জানান, এখন কী তদন্ত হচ্ছে তাও আমাদের জানা নেই।

সাগরের মা সালেহা মনির জানান, প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, বিচার হবে। কিছুই তো হল না। দীর্ঘদিন পার হয়ে গেল। আমার ছেলে ও ছেলের বউ কোনো রাজনীতি করত না। তারা দেশদ্রোহীও ছিল না। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজও করেনি। তবে তাদের হত্যার রহস্য কেন উদ্ঘাটন করা হচ্ছে না। তিনি মন্তব্য করেন, প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করতে নাটক সাজানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে সাগর-রুনীর হত্যার বিচার। তিনি বলেন, মামলায় যাদের আসামী ও গ্রেফতার করা হয়েছে তারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। তিনি আরও বলেন, সারা জীবন বিচারের আশায় থাকব। এ হত্যার বিচার ইহকালে না হলেও পরকালে অবশ্যই হবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সাগরের মাসহ সংশ্লিষ্ট সবার বক্তব্য গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা চলছে। আশা করছি, শিগগিরই দেশবাসী তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাবে। সাগর-রুনি দম্পতির একমাত্র সন্তান মাহির সারওয়ার মেঘ। মা-বাবা খুনের সময় পাঁচ বছরের মেঘের বয়স এখন ১৪ বছর। রাজধানীর ইন্দিরা রোডে নানার বাসায় মামার সঙ্গে থাকছে সে। গুলশানের একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পেরিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠছে মেঘ।

ডিআরইউ চত্বরে বিক্ষোভ: সাগর-রুনি হত্যার বিচার ও খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার ডিআরইউ এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ‘আমাদের প্রিয় দুই সহকর্মী সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনীর নির্মম হত্যাকান্ডের ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকৃত হত্যাকারীদের সনাক্ত ও গ্রেফতার করা হয়নি। বিচার প্রক্রিয়াও থমকে আছে। নিষ্ঠুর এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে ডিআরইউসহ গোটা সাংবাদিক সমাজ আজো সোচ্চার রয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি সাগর-রুনী হত্যার দশম বার্ষিকী। আমাদের প্রিয় দুই সদস্য হত্যার বিচার দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় ডিআরইউ চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন ডিআরইউ সভাপতি মুরসালিন নোমানী। এতে সাগর-রুনী পরিবারের সদস্য ও গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করবেন। সমাবেশে আপনার সক্রিয় উপস্থিতি আশা করছি।

https://dailysangram.com/post/443468