১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:০৫

ওরাতো মারণাস্ত্র-সভ্যতার ধারক

আমরা তো পরস্পরকে মানুষ হিসেবেই অভিহিত করে থাকি, কিন্তু আমাদের স্রষ্টা আমাদের মানুষ হিসেবে কতটা বিবেচনা করছেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এই বক্তব্যের মর্মটি সবাই হয়তো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন না, তবে যারা শোষিত-বঞ্চিত তথা মজলুম তারা বিষয়টি বুঝতে পারছেন। বর্তমান সভ্যতা আসলে মানবিক দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত নেই। দানবিক দর্শনে পরিচালিত বিশ্বব্যবস্থায় মানব জাতির কাক্সিক্ষত মুক্তি ও শান্তি সম্ভব নয়। সভ্যতার শাসকরা এখন পৃথিবীর সম্পদ মারণাস্ত্রের পেছনে ঢালছে এবং এভাবে তারা নিজেদের দানব বানিয়ে বিশ্বের মানুষকে চোখ রাঙাচ্ছে। এরা আবার সুন্দর সুন্দর পোশাক পড়ে সুন্দর সুন্দর কথাও বলে থাকে। গণতন্ত্র, শান্তি-মৈত্রী ও মানবাধিকার উচ্চারণ করতে ভোলে না এরা। মুখোশ পরে অভিনয় করতে সভ্যতার শাসকরা বেশ পারঙ্গম। পরাশক্তিগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্রকে তাদের অনুগত রাখতে চায় এবং এভাবে বাড়িয়ে চলে তাদের আগ্রাসনের মাত্রা। তবে এখনো পৃথিবীতে স্বাধীনচেতা জাতি ও নেতা আছেন। এদের স্থান পরাশক্তির অপছন্দের তালিকায়। সুযোগ পেলেই এদের শেষ করে দিতে চায় পরাশক্তিরা।

পরাশক্তি তথা মারণাস্ত্রের অধিকারী নেতারা শুধু বিশ্বের জন্য বিপদজনক নয়; তারা বিপদজনক নিজ দেশের মানুষের জন্যও। এর বড় প্রমাণ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছোট ছোট দেশের সামরিক জান্তারাও দেশের নাগরিকদের জন্য বিপদজনক। এর বড় উদাহরণ মিসর ও মিয়ানমার। আমরা জানি, নির্বাচনে কারচুপির ভুয়া দাবি তুলে অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বে একটা ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টি করেন। সেই উদাহরণটা যেন অনুসরণ করতে চাইলেন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন কয়েকের মাথায় মিয়ানমারে হয় সাধারণ নির্বাচন। ৮ নবেম্বরের এই নির্বাচনের পর স্পষ্ট হয়ে যায় দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)’ বিশাল বিজয়ের বিষয়টি। আর এই বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি সেনা সমর্থিত ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’। ফলে সেনাবাহিনী ও ডেভেলপমেন্ট পার্টি অবলম্বন করে ট্রাম্পের কৌশল।

তারা ট্রাম্পের অনুসরণে নির্বাচনের পর ভোটে কারচুপির ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলে। কিন্তু সেই অভিযোগের পক্ষে তারা কোন প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, মিয়ানমারে নবেম্বরের নির্বাচনে জালিয়াতির যে অভিযোগ সেনাবাহিনী তুলেছে, তার পক্ষে প্রমাণ নেই বললেই চলে। দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোও মিয়ানমারের এই নির্বাচনকে একটি ভালো ও সফল নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেছে। সামরিক জান্তা এসব কথা শোনেনি। তারা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে এবং অংসান সু চিসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বন্দি করে রেখেছে।

ট্রাম্পের সূত্র কাজে লাগিয়ে এখন মিয়ানমারের ক্ষমতায় সামরিক জান্তা। শোনা যায়, এর পেছনে সমর্থন রয়েছে পরাশক্তি চীনের। এদিকে ট্রাম্পকে হারিয়ে আর এক পরাশক্তি আমেরিকার ক্ষমতায় এলেন জো বাইবেন। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবারও উঠে এলো চীনের উইঘুর মুসলিম ইস্যু। উইঘুর, তিব্বত ও হংকংয়ের নাগরিকদের উপর চীন সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তা বন্ধে এবং চীনকে জবাবদিহির আওতায় আনতে যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছেন। দেশটির নতুন পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। তবে এখানে অন্য প্রশ্নও এসে যায়। উইঘুর মুসলিমদের কথা যারা বলছেন, তারা মজলুম ফিলিস্তিনীদের কথা কেন বলছেন না? ওরা কি অধিকার বঞ্চিত ও নির্যাতিত নয়? পর্যবেক্ষকরা তো বলছেন, ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং ফিলিস্তিনীদের বঞ্চনার বড় কারণ পরাশক্তি আমেরিকার পক্ষপাত। ট্র্যাজেডি হলো, নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত ফিলিস্তিনীরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোন বিচারও চাইতে পারছে না। আসলে বর্তমান সভ্যতায় পরাশক্তিরা ন্যায় ও শান্তির পক্ষে ভূমিকা রাখতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষুদ্র স্বার্থে ওরা দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে ওরা মারণাস্ত্র-সভ্যতার ধারক। ওরা মানবিক হবে কিভাবে?

ফিলিস্তিনীরাতো পৃথিবী নামক এই গ্রহেই বসবাস করছে, কিন্তু পৃথিবীবাসী তাদের দুঃখ-বেদনা কিংবা বঞ্চনার কথা শুনছে কী? আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, বর্তমান সভ্যতায় যারা পৃথিবী শাসন করছে সেই পরাশক্তিগুলো ফিলিস্তিনীদের বঞ্চনার কথা শুনছে না। বরং কোনো কোনো পরাশক্তি তো ফিলিস্তিনীদের দুঃখ-বেদনা ও বঞ্চনার মাত্রা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলকে।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, তথাকথিত সভ্য এই পৃথিবীতে মজলুম ফিলিস্তিনীরা বিচার প্রার্থনার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। হতাশাজনক এমন পরিস্থিতিতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যেন নতুন কথা শোনালেন। আইসিসি বলেছেন, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধÑ ওইসব অভিযোগ বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে।

আইসিসির বিচারকদের এই সিদ্ধান্ত আসার পরপরই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। ইসরাইল আইসিসির সদস্য নয়। দেশটির সরকার বলছে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আইসিসির এখতিয়ারের বিষয়টি তারা স্বীকার করে না। তবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক এই আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। আইসিসির কৌঁসুলি ফাতু বেনসুদা বলেন, তাঁর কার্যালয় আদালতের সিদ্ধান্তটি পর্যালোচনা করছে। এর ওপর ভিত্তি করেই তাঁরা নির্ধারণ করবেন, গুরুতর যুদ্ধাপরাধ ও নৃশংসতার বিচারে পরবর্তী সময়ে কী পদক্ষেপ নেয়া যায়। এদিকে আইসিসির বিচারকেরা শুক্রবার বলেন, ফিলিস্তিন এই আদালতের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। এছাড়া এই ভূখন্ডের কর্তৃপক্ষ সেখানকার পরিস্থিতি আদালতের কাছে তুলে ধরছে। এসবের ভিত্তিতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিচারকরা আরও বলেন, আদালতের এই এখতিয়ার ১৯৬৭ সালের পর ফিলিস্তিনের যেসব এলাকা ইসরাইল দখল করে নিয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এসব এলাকার মধ্যে গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুসালেম রয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আইসিসির এই সিদ্ধান্তের ফলে গুরুতর অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের জন্য প্রকৃত আশার সঞ্চার ঘটলো। আইসিসির সিদ্ধান্তের কারণে ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে পথ খুললো। বিবেকবান মানুষ তো শান্তি চায়, অপরাধের বিচার চায়। কিন্তু সভ্যতার শাসকরা কি চায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

https://dailysangram.com/post/443450