১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:৫২

নদী দখল বেশি, উদ্ধার কম

নদ-নদী দখল থামছে না। অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য বছরব্যাপী ব্যাপক কার্যক্রম (ক্রাশ প্রগ্রাম) ঘোষণার মধ্যেও দখল হয়েছে নদ-নদী। অবৈধ উচ্ছেদসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর গড়িমসি ও দায়িত্বহীনতার কারণে উচ্ছেদ অভিযান জোরদার হয়নি বলে উষ্মা প্রকাশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। কার্যত নদী দখল যতটা হয়েছে, উদ্ধার হয়েছে তার চেয়ে কম।

এ ছাড়া নদীর যেসব জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে তা-ও বাতিল হয়নি।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে গত ১২ জানুয়ারি।

কমিশনের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে ২০১৯ সালে যখন প্রথমবারের মতো নদ-নদীর অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা হয়, তখন সারা দেশে দখলদারের সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৩৯০। উচ্ছেদ হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৯টি দখল। একই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে নতুন দখলদারের সংখ্যা পাঁচ হাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে সারা দেশে ৬৩ হাজার ২৪৯।

নদীর অবৈধ দখল চিহ্নিত করার পর উচ্ছেদের জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে বছরব্যাপী ক্রাশ প্রগ্রাম ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট জেলা প্রশাসকদের কাছে ক্রাশ প্রগ্রাম পরিচালনার নির্দেশনা পাঠানো হয়।

পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও সক্ষমতা না থাকার কারণে জেলা প্রশাসন পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যাশিত উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারেনি বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অবৈধ উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসকদের ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অর্থ পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।

এ সম্পর্কে কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ‘অর্থ বিভাগ কর্তৃক অর্থায়নের পরিমাণ বাস্তব চাহিদার তুলনায় ছিল একেবারেই অপ্রতুল, অর্থাৎ উচ্ছেদের ক্ষেত্রে অর্থায়নে চরম গুরুত্বহীনতা ও অবহেলা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।’ এই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্ছেদ অভিযানের জন্য ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছে নদী রক্ষা কমিশন।

কমিশন বলছে, প্রশাসনিক কোনো ক্ষমতা না থাকার কারণে তাদের নির্দেশনা কাজে আসছে না। এ অবস্থায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনি ক্ষমতা দেওয়া ও স্বাধীন কমিশন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, তালিকা অনুসারে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি জেলা প্রশাসকদের নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে বলা হয়। একই সঙ্গে উদ্ধার করা নদ-নদী ও তীরভূমি, নদীর তীরের পূর্ববর্তী অংশ ভূমি (ফোরশোর) যাতে পুনরায় দখল না হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন বা উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের নিয়মিত পরিদর্শন ও নজরদারির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে বলা হয়।

কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে নামমাত্র। নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে উচ্ছেদ হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৯টি। উচ্ছেদের হার ৩২.৩৭ শতাংশ। কিন্তু নতুন করে দখল হওয়ায় এবং করোনাকালীন পরিস্থিতিতে উচ্ছেদ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ থাকায় উচ্ছেদের হার কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৯.৬৬ শতাংশ।

নদী রক্ষা কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি নদী দখলদার খুলনা বিভাগে। সেখানে দখলদারের সংখ্যা ১১ হাজার ২৪৫। এই বিভাগে ২০১৯ সালে উচ্ছেদ করা হয়েছে চার হাজার ৮৯০টি অবৈধ দখলদারকে। নদী দখলদারের সংখ্যা সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে দুই হাজার ৪৪। উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫৭৬ জনের অবৈধ স্থাপনা।

ঢাকা বিভাগে নদী দখলদারের সংখ্যা আট হাজার ৮৯০; উচ্ছেদ করা হয় এক হাজার ৪৫২ জনের পাঁচ হাজার ৯৩৫টি স্থাপনা। ঢাকা জেলায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, ইছামতী, বালু, বংশী, গাজীখালী, কালীগঙ্গাসহ মোট ১১টি নদ-নদী ও ২০১টি খালের উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। ঢাকা জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা ছয় হাজার ৭৫৮; উচ্ছেদ করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৯৯ জনের স্থাপনা। নারায়ণগঞ্জে ৯টি নদী ও ২১৮টি খাল রয়েছে। সেখানে নদী ও খাল দখলদারের সংখ্যা ৭৮৫। মানিকগঞ্জে নদীর সংখ্যা ১৬, আর খাল ১১৭টি; দখলদারের সংখ্যা এক হাজার ৩৯৯। ফরিদপুরে ১৩টি নদী ও ১৫টি খাল রয়েছে; দখলদারের সংখ্যা এক হাজার ৮৩৪। টাঙ্গাইলে নদী দখলদারের সংখ্যা এক হাজার ৭৮৮।

নদ-নদী রক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন অনুসারে জেলা নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে জেলা প্রশাসক কী কী আইন প্রয়োগ করতে পারবেন তা-ও উল্লেখ করা হয়েছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দেওয়া উচ্ছেদ কার্যক্রমের নির্দেশনায়। নদ-নদী রক্ষায় হাইকোর্টের ১৩৯৮৯/২০১৬ নম্বর রিট পিটিশনের আদেশও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা উল্লেখ করে বলা হয়, নদীর জমি কোনো ব্যক্তি/গোষ্ঠী/প্রতিষ্ঠানের নামে মালিকানা থাকলে তা বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে জেলা প্রশাসকের। একইভাবে জমি কোনো ব্যক্তি/গোষ্ঠী/প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ড হয়ে থাকলেও তা বাতিল ও সংশোধন করার ক্ষমতা রয়েছে জেলা প্রশাসকের। এ প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জারি করা একটি পরিপত্রও যুক্ত করা হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা নদীর ভূমির অবৈধ ইজারা বা বর্গা (সাব-লিজ) বাতিল করেনি। জরিপ রেকর্ডে কালেক্টর বা ভূমি কার্যালয়ে ইচ্ছাকৃত বিচ্যুতি এবং প্রতারণামূলক ত্রুটি ধরা পড়লেও তা সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। প্রতারণামূলক ত্রুটিসমূহ সংশোধন করে নদ-নদীর তীরভূমি, ফোরশোরের ভূমির অবৈধ খতিয়ান (রেকর্ড-অব-রাইটস) বাতিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ধারা প্রয়োগে গড়িমসি, দায়িত্বহীনতা, অযোগ্যতা ও অদক্ষতা বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে বলে নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।

নদী রক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে ও গড়িমসি করেছে কিংবা কার্যকর উদ্যোগ নিতে কালক্ষেপণ করেছে, এর জন্য ওই সব প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহির অভাবকে দায়ী করেছেন কমিশনের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার। নদী রক্ষা কমিশনের কাছে জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণেই উদ্ধার কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায়নি বলে তিনি মনে করেন। এ জন্য তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে একটি কার্যকর স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। একই সঙ্গে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ সংশোধন করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন মজিবুর রহমান।

জানা গেছে, কমিশনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩’ সংশোধন করে খসড়া আইনটি আইন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। কমিশন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর পরীক্ষা করবে (ভেটিং)। এরপর যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংসদে উপস্থাপন করা হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য শারমিন সোনিয়া মোরশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা এবং নদী দখল ঠেকানোর জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে এই কাজ সম্ভব হবে না। সুপ্রিম কোর্টের রায়েও এ ব্যাপারে সরকারকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

উচ্ছেদের ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা জানার জন্য খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ময়ূর নদীসহ ২৬টি খালে অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য আমরা অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা সবার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজটি করার চেষ্টা করেছি। কিছু কিছু দখল আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। সেগুলো উচ্ছেদের জন্য আমরা আদালতের মাধ্যমে এগোচ্ছি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/02/10/1003504