১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:৫১

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে

ভোজ্য তেলের দাম বাড়াতে ব্যবসায়ীদের অভিনব কৌশল

লিটারপ্রতি যে ভোজ্য তেলের দাম এক বছর আগে ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। দেশের ভোজ্য তেলের বাজার ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করে অভিনব কায়দায় তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়াতে ইচ্ছা করে দেরিতে বাজারে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা দিলে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেন। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার প্রবণতা দেখা দিলে ইস্যু করা সাপ্লাই অর্ডারে ভোজ্য তেল তুলতে অনীহা প্রকাশ করেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের এই কূটকচাল তুলে ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভোজ্য তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার বাজার মনিটর করছে। কোনো অসাধু ব্যবসায়ী অসৎ উদ্দেশ্যে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে এবং তার প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্যারিফ কমিশন যে সুপারিশগুলো করেছে, তা বিবেচনায় নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।’

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের তুলনা করলেই দামের পার্থক্য বোঝা যাবে। সরকারের উচিত অশুভ উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীরা তেল মজুদ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। আর মনিটরিং আরো জোরদার করতে হবে। এমনিতেই করোনার কারণে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে, বেতন-ভাতা, আয় কমে গেছে। এই অবস্থায় নিত্যপণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে মানুষ আরো বিপাকে পড়বে। সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’

বর্তমানে বাজারে পাঁচ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের দাম ৬৫০ থেকে ৬৮৫ টাকা। ছয় মাস আগে এই তেলের দাম ছিল ৫১০ থেকে ৫১৫ টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানে ক্রেতাসাধারণকে বাড়তি দিতে হচ্ছে ১৪০ টাকারও বেশি। বাড়তি এই টাকা দিয়ে আরো প্রায় দেড় লিটার তেল কেনা যেত। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে খোলা সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি বিক্রি হতো ৮২ থেকে ৮৫ টাকা। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। বর্তমানে কম্পানিভেদে তা ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বিদ্যমান সাপ্লাই চেইনের সমস্যাসহ ব্যবসায়ীদের কূটকৌশলগুলো তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খোলা ভোজ্য তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে ভোজ্য তেল পরিশোধনকারী মিলগুলো পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরবরাহের যে আদেশ নেয় তার মেয়াদ ১৫ দিন। কিন্তু দেখা যায়, সরবরাহ আদেশের এই তেল সরবরাহ করা হয় তিন থেকে চার মাস ধরে। এতে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের সাপ্লাই অর্ডার (এসও) বাজারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আবার মিলগুলো ইচ্ছা করে তাদের উৎপাদনক্ষমতার বেশি পরিমাণ সরবরাহ আদেশ ইস্যু করে। এতে চাহিদামতো ভোজ্য তেল সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফলে এই অবস্থায় বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে দাম বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের ভোজ্য তেলের বাজার আমদানিনির্ভর হওয়ায় ব্যবসায়ীরা দাম নিয়ে নানা কূটকচাল চালেন। কমিশন বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা দিলে মিলগুলো আগে ইস্যু করা সাপ্লাই অর্ডারের ভোজ্য তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে নতুন সাপ্লাই অর্ডারের ভোজ্য তেল সরবরাহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। নতুন অর্ডারে দাম বেশি থাকে বলে বাজারে এর নেতিবাচব প্রভাব পড়ে। আবার এর উল্টো চিত্রও দেখা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার প্রবণতা দেখা দিলে সাপ্লাই অর্ডারের মালিকরা মিল থেকে ইস্যু করা ভোজ্য তেল উত্তোলনে অনীহা দেখান। এই অবস্থায়ও বাজারে সরবরাহ চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার মিলগুলো রেগুলার সাপ্লাই অর্ডার ছাড়াও অনেক সময় বিশেষ সাপ্লাই অর্ডার ইস্যু করে। এতেও বাজারে সরবরাহ চেইনে সমস্যা সৃষ্টি হয়।

কমিশন তাদের প্রতিবেদনে মিল মালিকরা যাতে উৎপাদনক্ষমতার চেয়ে বেশি সাপ্লাই অর্ডার ইস্যু করতে না পারেন সে জন্য পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি ভোজ্য তেল বিক্রি করতে তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে এলাকার জন্য সাপ্লাই অর্ডার ইস্যু করে, সেই এলাকার বাইরে অন্য কোনো এলাকায় যেন সরবরাহ করতে না পারে এই বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছে। আর সাপ্লাই অর্ডারের মেয়াদ যেন ১৫ দিনের বেশি না হয় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতেও কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/02/10/1003527