১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:৫১

বিআরটির বারোমাসি ভোগান্তি

৯ বছর ধরে চলমান প্রকল্প কবে শেষ হবে কেউ জানে না দুর্ভোগ কমানোর প্রকল্পই এখন বিষফোঁড়া : ধুলায় অন্ধকার ১৩ কি.মি. সড়কজুড়ে যানজট

ঢাকার প্রবেশমুখে যানজটের দুর্ভোগ কমাতে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য ২০১২ সালের ডিসেম্বরে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-বিমানবন্দর) অনুমোদন করে সরকার। ৯ বছর ধরে প্রকল্পটি চলমান বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। । গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৩৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। পরে তা বেড়ে হয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। কচ্ছপ গতিতে চলমান প্রকল্পটি কবে শেষ হবে তা কেউ জানে না। দুর্ভোগ কমানোর প্রকল্পটি এখন বারোমাসি ভোগান্তির উৎস হয়েছে।

এ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ঢাকার উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩ কিলোমিটার সড়ক ধূলায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর অব্যবস্থাপনায় পুরো পথই এখন যানজটের দখলে। টঙ্গী সেতু থেকে গাজীপুরের চৌরাস্তা পর্যন্ত যেতে সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। কখনও কখনও লাগে এর চেয়ে বেশি। ভুক্তভোগিরা জানান, প্রায় ৯ বছর ধরে চলমান এ প্রকল্পের কারণে ১৩ কিলোমিটার সড়কের দুপাশের ব্যবসা বাণিজ্য লাঠে উঠেছে। অনেকেই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। ধূলার দূষণে অসুস্থ রোগী এখন ঘরে ঘরে। শীতে বহু মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। জয়দেবপুর-বিমানবন্দর অংশ নির্মাণে সীমাহীন দুর্ভোগের কারণে বিআরটির বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ অংশ (সাউথ ফেজ) তৈরির পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে এসেছে সরকার। খন্ডিত বিআরটিতে কতটা সুফল আসবে, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ২০১২ সালের প্রকল্প ‹বিআরটি› চার বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ৩৫ ভাগ। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বিআরটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও কাজই শুরু হয় তার আরও চার মাস পর। তখন বলা হয়েছিল, ২০২০ সালে কাজ শেষ হবে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) দ্বিতীয় সংশোধনী অনুযায়ী ২০২২ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কাজের যে অগ্রগতি, তাতে আশার আলো দেখছেন না কেউ। প্রকল্পের ফ্লাইওভার ও ১০ লেনের টঙ্গী সেতু সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২২ সালের আগস্টের আগে কাজ শেষ হবে না।

প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেল, পুরো নির্মাণ এলাকার রাস্তা ভাঙাচোরা। গাড়ি চলে হেলেদুলে। সড়কের কোথাও বিআরটির উড়াল অংশের পিলার তৈরি শেষ। পিলারের গোড়ায় সেখানে বিশাল গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এতে রাস্তা সরু হয়ে চলাচলের পথ কমায় গাড়ি আটকে থাকছে। যেখানে বিআরটি সড়কের মাঝবরাবর হচ্ছে, সেখানেও রাস্তার অবস্থা করুণ। খানাখন্দে গাড়ি আটকা পড়ছে।

রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে ২০০৫ সালে প্রণীত কৌশলগত পরিকল্পনায় (এসটিপি) তিনটি মেট্রোরেল ও তিনটি বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। ২০১৬ সালে অনুমোদিত সংশোধিত এসটিপিতে (আরএসটিপি) পাঁচটি মেট্রোরেল ও দুটি বিআরটির সুপারিশ রয়েছে। জয়দেবপুর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত বিআরটি-৩ নির্মাণ করতে বলা হয়। বিআরটি পদ্ধতিতে সড়কের মাঝবরাবর বাসের জন্য পৃথক লেন নির্মাণ করা হয়। যেখানে সড়ক সরু, সেখানে ফ্লাইওভারে বাসের নির্ধারিত লেন করা হয়। বাস যেন কোনো সিগন্যালে না আটকা পড়ে, সে জন্য মোড়ে ওভারপাস করা হয়। এ পদ্ধতিতে ট্রেনের মতো বিনা বাধায় বাস চলতে পারে। যাত্রী ওঠানামায় রাস্তায় থাকবে স্টেশন।

পরিকল্পনায় জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা, টঙ্গী, উত্তরা, বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী, কাকরাইল, পল্টন, পুরান ঢাকা হয়ে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত ৪১ কিলোমিটার বিআরটি-৩ নির্মাণের সুপারিশ থাকলেও তা হচ্ছে না। জয়দেবপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত কাজ চলছে। এ অংশ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্ভোগের কারণে বাকি অংশ নিয়ে আগ্রহী নয় সরকার। স¤প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গাজীপুরে যে দুর্ভোগ হচ্ছে, তা টেনে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে আনতে চান না। রাজধানীতে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। বিআরটির দরকার নেই। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে আগ্রহী হলেও প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগিরা জানান, ঢাকার বিমান বন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত পুরো রাস্তাই এখন বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। ধুলায় চোখেও কিছু দেখা যায় না। একই অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। টঙ্গীর হোসেন মার্কেটের শহীদ নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, মাসের পর মাস ধরে ধুলার যন্ত্রণা, দোকানের সামানের অংশ ঢেকে রেখেও রক্ষা পাচ্ছি না। দোকানদারি করে হাঁপানির রোগী হয়ে গেছি। এই শীতে অনেকেই রোগী হয়ে গেছে। ধুলার কারণে কাস্টমারও আসে না। বেচাকেনা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, ৮ বছর ধরে ব্যবসায় মন্দা। এ কারণে অনেকেই ব্যবসা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। এ পথে চলাচলকারী বলাকা পরিবহনের চালক ইছাহাক বলেন, আধা ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে ২/৩ ঘণ্টা লাগে। বাসের মধ্যে বসে যাত্রীরা ধুলায় সাদা হয়ে যায়। আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। যাদের উপায় নেই তারাই শুধু এ পথে যাতায়াত করে। গাজীপুর বোর্ডবাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, টঙ্গী সেতু থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত দুপাশের সড়কের যে হাল, তাতে মনে হয় এর চেয়ে খারাপ সড়ক দেশের আর কোথাও নেই। অথচ এটিই রাজধানীর সঙ্গে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান সড়ক। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ এই পথে যাতায়াত করছে দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, টঙ্গী সেতু থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। উত্তরা থেকে ধরলে প্রায় ১৩ কিলোমিটার। প্রতিদিন সকাল থেকেই এই সড়কের উভয় পাশ শত শত বাস, ট্রাক, লরি, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটো আর রিকশার জটলায় প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। এই অবস্থা চলতে থাকে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত। পুরোনো পিচঢালা সড়কের বুকে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। সেগুলো ভরাট করা হয়েছে ইট-সুরকি ফেলে। বৃষ্টির পানি আর যানবাহনের চাকার চাপে বহু জায়গায় সেই জোড়াতালি উঠে গেছে। দুপাশে দোকানপাট তুলে সড়কের জায়গা দখল করা হয়েছে। এতে অনেক জায়গায় সড়ক সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নর্দমা উপচে পড়া পচা পানি। আশপাশের কারখানাগুলোর রাসায়নিক বর্জ্য মেশা পচা পানি পুঁতিগন্ধময় ও বিষাক্ত করে তুলেছে পরিবেশ। এ নিয়ে মানুষের ভোগান্তির যেন শেষ নেই।

গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি-ধান-ইক্ষু গবেষণার জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক, কর্মকর্তা, কর্মাচারীদের অনেকে যাতায়াত করেন সকালে-বিকেলে। এ ছাড়া টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে গড়ে উঠেছে বহু শিল্পকারখানা। এসব কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদেরও অনেকে এই সড়কের নিয়মিত যাত্রী। আবার গাজীপুর, শফিপুর, মৌচাক, কোনাবাড়ী এলাকার অনেক মানুষ ঢাকায় চাকরি করেন। তারাও নিয়মিত যাত্রী। এতে অফিস শুরু ও ছুটির সময় যানজট বাড়ে। তাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে রাজধানীতে আসা যাত্রীবাহী বাস ও অন্যান্য যানবাহনকে ঢাকা শহরে প্রবেশের আগে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় এসে পড়তে হয় বিরক্তিকর দীর্ঘ যানজটের কবলে। একই অবস্থা ঢাকা ছেড়ে যাওয়া যানবাহনগুলোর ক্ষেত্রেও। সেগুলো আটকা পড়ে টঙ্গী সেতু থেকে। এ ছাড়া চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে যেসব দূরপাল্লার যানবাহন বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুরে যাতায়াত করে, তার যাত্রীদেরও একই রকম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ কারণে ভুক্তভোগিরা বিআরটির এ ভোগান্তিকে এখন বলে থাকেন বারোমাসি ভোগান্তি।

এদিকে, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার কারণ হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো চিঠিতে বলছে, প্রকল্প এলাকা কাজের উপযোগী ছিল না। রাস্তার নিচের ভূগর্ভস্থ পরিষেবা লাইন নকশা অনুযায়ী ছিল না। তা স্থানান্তরে বাড়তি সময় লেগেছে। রাস্তার পাশে ড্রেন না থাকায় পানিবদ্ধতায় বিলম্ব হয়েছে। করোনা মহামারি কাজ ছয় মাস পিছিয়ে দিয়েছে। এ প্রকল্পে বারবার বদল হয়েছেন পরিচালক। এ কারণে প্রকৃতপক্ষে কবে নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না।

https://www.dailyinqilab.com/article/356826/