১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:৪৯

সীমান্ত হত্যার তদন্ত ও বিচার দাবি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের

বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে নতুন করে হত্যার তদন্ত ও বিচারের জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা বলেছে, এসব বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়েছে। ৯ই ফেব্রুয়ারি নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেয়া এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা আরো লিখেছে, ১০ বছর আগে ভারত সরকার ঘোষণা দিয়েছিল তারা সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের পরিবর্তে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে এবং ধৈর্য্য ধারণের নির্দেশ দেবে বিএসএফকে। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশি বেসরকারি সংগঠনগুলো রিপোর্ট করছে যে, বিএসএফ অব্যাহতভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। তারা সীমান্তে বসবাসকারী ভারতীয় ও বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও অশোভন আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তে গবাদিপশু পাচার, অবৈধ উপায়ে সীমান্ত অতিক্রম বন্ধে সীমান্তে রক্ষী মোতায়েন করেছে ভারত। তাদের দাবি, যখন তাদের ওপর আক্রমণ আসে শুধু তখনই তারা শক্তির ব্যবহার করে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলী বলেন, ভারত সরকার সীমান্ত রক্ষীদের বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করার নির্দেশ দিয়েছে। তাদের সেই নির্দেশ নতুন নতুন হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও অন্যান্য গুরুতর অন্যায় থামাতে পারেনি। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এ কারণে তারা আরো বেশি দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের হয়রানি ও নির্যাতন করছেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বেআইনি হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং এ জাতীয় চর্চা থেকে বিরত থাকতে সরকারি নির্দেশনা দিয়েছে ভারত। তারা বাংলাদেশকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আলোচনায় এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ অধিকার অভিযোগ করেছে যে, সীমান্ত রক্ষাকারীরা ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৩৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এ সময়ে তারা আরো নানা রকম মারাত্মক নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে তারা হত্যা করেছে ৫১ জনকে। ভারতের বেসরকারি সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে বিএসএফের হাতে কমপক্ষে ১০৫টি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করেছে। এরপর তারা বলেছে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। মাসুম আরো রিপোর্ট করেছে যে, বিএসএফের সেনারা খেয়ালখুশিমতো সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটক করে নির্যাতন ও হয়রানি করছে। সীমান্তের ভেতরে ভারতীয় অধিবাসীদেরও তারা হুমকি দিয়েছে।

ভারতের ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের কাছে রিপোর্টে মাসুম বলেছে যে, ২০২০ সালের ১৮ই নভেম্বরে বিএসএফের সেনারা পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার রাজ্যে শমসের প্রামাণিক (১৬)কে প্রহার করে গুলি করেছে সীমান্তে গরু পাচারের অভিযোগে। শমসের প্রামাণিক সীমান্তে গরু পাচারের চেষ্টা করছিল এমন অভিযোগে সেনারা তাকে আটক করে। এরপর বাঁশের লাঠি ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাকে প্রহার করতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে অচেতন হয়ে না পড়ে। এরপর তার বুকে গুলি করে এবং সীমান্ত বেড়ায় তাকে ফেলে রেখে যায়। এ ঘটনায় হলদিবাড়ি পুলিশ স্টেশন একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা করে। তারা এ বিষয়ে আর কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। মাসুম আরো রিপোর্ট করেছে যে, কুচবিহার জেলায় ২০২০ সালের ৯ই আগস্ট শাহিনুল হক (২৩) নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফের এক সদস্য। এদিন স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় নিজের বাড়ির সামনে তার এক ভাই ও কাজিনদের সঙ্গে মোবাইল ফোন নিয়ে গেমস খেলছিল শাহিনুল হক। এ সময় ওই বিএসএফের এক সদস্যের ছোড়া রাবার বুলেট তাকে আঘাত করে। এরপর তাকে প্রহার করে সে। এরপর গুলি করে। এ ঘটনায়ও পুলিশ একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা করেছে। মিডিয়ার খবরে বলা হয়, ২০২০ সালের ১৯শে এপ্রিল এক বিএসএফ সেনা সদস্য বাংলাদেশি ১৬ বছর বয়সী শিমন রয়কে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলায় হত্যা করে। তার পিতা একজন স্কুলশিক্ষক। তিনি বলেছেন, তিনি ও তার ছেলে মিলে তাদের পাটক্ষেতের বেড়া নির্মাণ করছিলেন। এ সময় এক বিএসএফ সদস্য বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর প্রবেশ করে তাদেরকে সেখান থেকে চলে যেতে বলে। তারা এ সময় দাবি করেন যে, তারা নিজেদের জমিতে কাজ করছেন। এমন প্রতিবাদ জানানোর পর ওই সেনাসদস্য তার ছেলের পেটে গুলি করে।

২০২০ সালের ৪ঠা জুলাই বিএসএফের এক সেনাসদস্য চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলায় ৫০ বছর বয়সী এক বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে। স্থানীয় এক আইন প্রণেতা বলেছেন, ওই ব্যক্তি ঘটনার দিন তার গবাদিপশুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন। অসাবধানতাবশত তিনি ভারত সীমান্তে প্রবেশ করেছিলেন। বিএসএফ সদস্য তাকে হত্যা করে। এরপর তার মৃতদেহ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় অধিবাসীরা ও অধিকারকর্মীরা অভিযোগ ও ন্যায়বিচার পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পক্ষান্তরে তাদেরকে হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। মাসুম-এর অধিকারকর্মীরা বলেছেন, তাদেরকে পুলিশ ও বিএসএফ থেকে নিয়মিত হুমকি দেয়া হয়। এর মধ্যে তাদেরকে আটক করার হুমকি দেয়া হয়। বানোয়াট ক্রিমিনাল মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিপুল পরিমাণ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে অনেক মানুষ তাদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য এপার-ওপার হন। তারা প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে যান। কাজের সন্ধানে যান। কেউ কেউ সীমান্তে ভয়াবহ অপরাধে জড়ান। কিন্তু সন্দেহজনকদের গ্রেপ্তার করে পুলিশে হস্তান্তর করার পরিবর্তে বিএসএফ জওয়ানরা তাদেরকে প্রহার ও নির্যাতন করে। আবার কিছু সীমান্তরক্ষী গরু ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যারা এসব ক্ষেত্রে উৎকোচ দিতে অস্বীকৃতি জানায় তারা তাদেরকে টার্গেট করে। সীমান্তে নির্যাতনের বিরুদ্ধে বার বার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। আগস্টে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছে দ্বিপক্ষীয় সব চুক্তির লঙ্ঘন এসব ঘটনা। এজন্য ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানো উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

মীনাক্ষি গাঙ্গুলী বলেছেন, সীমান্তরক্ষীদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধ করে বাংলাদেশ সীমান্তে নির্যাতনের বিষয়ে প্রতিশ্রুত শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করা উচিত ভারত সরকারের। অপরাধের জন্য দায়ী নিরাপত্তা কর্মীদের বিচার করার মধ্য দিয়ে ভারত প্রমাণ দেখাতে পারে যে, তারা আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=262223