১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:৩৯

দেড় লাখ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দখলে ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি

দখলকারীরা বনভূমি দখল করে হাটবাজার, দোকান, রিসোর্ট, কটেজ, কৃষি ফার্ম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা স্থাপন করেছেন। ভরাট হচ্ছে নদী-নালা হাওর খাল-বিল। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। কমছে চাষাবাদের জমি। ভবিষ্যতে আসছে মারাত্মক বিপর্যয়। বন বিভাগ জানায়, সারা দেশে বনের জমি জবরদখল করে রেখেছেন মোট ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ জন। তাদের দখলে আছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি। বনের জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে তৈরি করা হয়েছে শিল্পকারখানা। দখলের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি সংরক্ষিত বনভূমিও। মোট দখলদারদের মধ্যে ৮৮ হাজার ২১৫ জন সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে রেখেছেন। তাদের জবরদখলে আছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ দশমিক শূন্য ৬ একর সংরক্ষিত বনভূমি।

জানা গেছে, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অবৈধ দখলে থাকা বনভূমি উদ্ধারে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা স্থাপন করে যে বনভূমি দখল করা হয়েছে, সেগুলো উদ্ধারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করার সুপারিশ করা হয়েছে। বন বিভাগ জানায়, দখল করা এই বনভূমি রয়েছে ২৮টি জেলায়। বন বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি কক্সবাজারে। এই জেলায় মোট দখল হওয়া জমির পরিমাণ ৫৯ হাজার ৪৭১ একর। দখলকৃত জমির মধ্যে এক লাখ ৩৮ হাজার একর সংরক্ষিত বন ৮৮ হাজার ২২৫ জন ব্যক্তি ও সংস্থার দখলে ছিল। সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে দখলদারদের নামসহ তথ্য-উপাত্ত জমা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, এক লাখ ৬০ হাজার একর বনভূমি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয়েছে ৪৩ হাজার ৯৫ একর জমি। এ ছাড়াও, অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার ২২১ একর বনভূমি। সংসদীয় কমিটির কাছে দাখিলকৃত নথি অনুসারে, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯৩ হাজার ৯২৩ একর বনভূমি।

এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বনভূমি দখলকারীদের নাম প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। যাতে করে জনগণ তাদের শনাক্ত করতে পারে এবং দখলদারদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বনভূমি দখলকারীদের একটি সম্পূর্ণ এবং বিস্তারিত তালিকা পেয়েছি। এটি পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার এক বিশাল নথি। দখলকৃত এসব বনভূমি দ্রুত উদ্ধারে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, দখলদারদের কাছ থেকে বনভূমি উদ্ধার করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যেই জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি দিয়েছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে যেন ‘ভালো পরিমাণ’ বনভূমি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
বন বিভাগ জানিয়েছে, গত অক্টোবর থেকে শুরু করে তিন মাসে ইতোমধ্যে ৫৩৪ একর বনভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উন্নয়নের নামে বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ করতে সুপারিশ করেছে কমিটি।

গত ডিসেম্বরে বান্দরবানে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী রক্ষার দাবিতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশ এর প্রকল্প ‘প্রমোশন অফ এগ্রো ইকোলজি প্রাকটিসেস ইন দ্যা সিএইচটি’ (পেপ) ও বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল, বিভিন্ন এনজিও ও সামাজিক সংগঠন এবং সুশীল সমাজের মানুষ মানববন্ধন করেছে। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, পার্বত্য জেলা বান্দরবানের পানির অন্যতম উৎস সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী আজ মৃত প্রায়, প্রতিবছরই অবৈধ দখল ও দুষণের কারণে নদী দুটি আজ তার নাব্যতা হারিয়েছে। নদী দুটিকে বাঁচানো এখন সবার প্রাণের দাবি। মানববন্ধনে এসময় বক্তারা নদী দুটির নদীর সীমানা নির্ধারণ, অবৈধ দখল ও দুষণমুক্ত করার জোর দাবি জানান। গত ডিসেম্বরে সাঙ্গু-মাতামুহুরি বনভূমি দখলের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায়। এই জমিতে বসবাসকারী প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নানা কারণে বিপন্ন হয়ে পড়া শঙ্খ ও মাতামুহুরী দিন দিন আরও বেশি বিপন্নতার দিক ধাবিত হচ্ছে। আরাকান পাহাড় থেকে উৎপত্তি শঙ্খ নদের দৈর্ঘ্য ১৯৩ কিলোমিটার ও মাতামুহুরীর ১৭০ কিলোমিটার। অবস্থার পরিবর্তন না হলে আগামী কয়েক দশকে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পুরোপুরি নাব্যতা হারিয়ে ফেলবে। একই সঙ্গে পাহাড় থেকে নদীতে নেমে আসা জলধারাগুলো মরে গেলে আরও বেশি সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা দেবে। এ জন্য ‘শঙ্খ ও মাতামুহুরী অববাহিকা পুনরুদ্ধার সমীক্ষা’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। একমাত্র এ দুটি পাহাড়ি নদীই দেশের অভ্যন্তরে উৎপত্তি ও সাগরে পতিত হয়েছে বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।

এর আগে গত ডিসেম্বরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন জানায়, দেশের ৫ হাজার ৯৮২ ব্যক্তি ১লাখ ৪ হাজার ১৪৯.১৭ একর সংরক্ষিত বনভূমি জবর দখল করে হাটবাজার, দোকান, রিসোর্ট,কটেজ, কৃষি ফার্ম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ১৪০ জন ৮২০.৩৪ একর সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানা স্থাপন করেছেন। বন বিভাগের নামে রেকর্ডকৃত এসব অবৈধ দখলকৃত সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধারে প্রথম অভিযান চালানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার বনবিভাগের অবৈধ দখলকৃত সংরক্ষিত বন উদ্ধারে অভিযান চালানো হবে। পরবর্তীতে দেশের অবশিষ্ট অঞ্চলের বনভূমি থেকে দখলদারদের উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হবে। তিনি জানান, ৮২ হাজার ৯৩ জন ব্যক্তি ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৪৩ দশমিক ৫৫ একর সংরক্ষিত বনভূমি অবৈধ ভাবে দখল করে ঘরবাড়ি, কৃষি জমি তৈরি করেছে। সারাদেশে মোট ৩ লাখ ৩১ হাজার ৯০৭.৫২ একর সংরক্ষিত বনভূমির ১৩৮৬১৩.৬ একর মোট ৮৮ হাজার ২১৫ জন জবরদখলকারী দীর্ঘদিন ধরে দখলে রেখেছে। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বনের নামে রেকর্ডকৃত সকল সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধারের এই কর্মসূচি চলমান থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ৭০০ এর মতো নদী, উপনদী ও শাখা নদী আছে। এ নদীগুলো সারাদেশে রক্তের শিরা-উপশিরার মতো বহমান। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা এবং মেঘনা এই নদ-নদীর মিলিত নিষ্কাশন অববাহিকার আয়তন প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ বর্গকিলোমিটার। নদ-নদীগুলো বঙ্গোসাগরে বয়ে নিয়ে আসে প্রচুর পরিমাণ পলি। ব্রহ্মপুত্র-যমুনাই শুধু প্রতিদিন ১২ লাখ টন পলি বহন করে আনে। প্রতি বছর গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী প্রণালির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বয়ে আনা পলির পরিমাণ প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন। তিস্তার বুকে ধু-ধু বালুচর। একই অবস্থা পদ্মার। নদ-নদী ভরাট হওয়ায় কমছে নৌপথ। ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে ১৯ হাজার কিলোমিটার নৌপথ। দেশে একসময় ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ ছিল। দখল, দূষণ ও ভরাটে হারিয়ে গেছে ১৯ হাজার কিলোমিটার নৌপথ। বর্তমানে ৫ হাজার কিলোমিটারেরও কম নদীপথে চলছে নৌযান। সারাদেশে রয়েছে ৫৩টি নৌরুট। কমে যাচ্ছে নদীর নাব্যতা। দেশের প্রায় ১৪০টি নদ-নদী এখন মৃতপ্রায়। দেশের প্রায় ১৩টি নদীর অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে এসব নদী। জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে কৃষিজমি। কৃষিজমি কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫২ ও ১৩৫২৮ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে ২১০৪ ও ১২৭১৮ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টর। ১৯৬০ সাল হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল যথাক্রমে ৩২ দশমিক ৫০ ও ৫২ দশমিক ৫০ হ্রাস পেয়েছে। জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট ও দখলের ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং নগরবাসী প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। জানা গেছে, দেশের ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথের নাব্য বাড়ানোর খসড়া মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বি আইডব্লিউটিএ)। এর আওতায় ১৭৮টি নদী খনন (ড্রেজিং) করা হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে এ কর্মযজ্ঞ শেষ করতে চায় সংস্থাটি। খসড়া পরিকল্পনায় প্রাধান্য পেয়েছে হাওর, পার্বত্য ও দক্ষিণাঞ্চলের ৮০টি নদ-নদী। এর মধ্যে বরিশাল ও খুলনা বিভাগে রয়েছে অর্ধশত নদী খনন। এ কর্মযজ্ঞে মোট ব্যয় হবে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও এত বিশাল নৌপথ খনন করার মতো সক্ষমতা ও জনবল এ মুহূর্তে সংস্থাটির নেই। উল্লেখ্য, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর।

https://dailysangram.com/post/443376