৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১২:৪২

দরপত্রের নিয়ম বদলের উদ্যোগ

সরকারের শর্তেই মুষ্টিমেয় ঠিকাদারের হাতে সব কাজ

দরপত্রের শর্তের কারণেই মুষ্টিমেয় ঠিকাদার সরকারি সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পেয়ে যাচ্ছে। সরকারের এসব নিয়মকানুনের ফাঁকফোকরে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এব কাজ পেয়েই যাচ্ছে। আর ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বঞ্চিত হচ্ছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকছে। বিদেশিরা কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। একই প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে অনেক কাজ পাওয়ায় গুণমান ঠিক থাকছে না। নির্ধারিত সময়েও কাজ শেষ হচ্ছে না।

খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠান যেন সব কাজ না পায়। একই ঠিকাদারকে একই সঙ্গে অনেক প্রকল্পের কাজ দেওয়া যাবে না। একটি কাজ শেষে আরেকটি কাজ পাবে। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কাজ পায় সে ব্যবস্থাও করতে হবে।

সরকারপ্রধানের এ অনুশাসন বাস্তবায়নে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো খতিয়ে দেখছে কী কী কারণে একই প্রতিষ্ঠান অনেক প্রকল্পের ঠিকাদারি পাচ্ছে। কেন ছোট ও দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বঞ্চিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সূত্রে জানা গেছে, দরপত্রের শর্তের বেড়াজালের কারণেই এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এসব শর্ত বদলের সুপারিশ ইতোমধ্যে সরকারি কেনাকাটার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ক্রয় ও কারিগরি ইউনিটে (সিপিটিইউ) পাঠিয়েছে সওজ। মুষ্টিমেয় ঠিকাদারের হাতে সব কাজ চলে যাওয়া ঠেকানোর পথ খুঁজতে আজ মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সভা ডেকেছে।

সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা) এ কে এম মনির হোসাইন পাঠান বলেছেন, 'টেন্ডার ক্যাপাসিটি ফর্মুলা' ও 'টেন্ডার মূল্যায়ন ম্যাট্রিক্স'-এর নিয়ম বদলের প্রস্তাব করা হয়েছে। আরও কিছু সুপারিশ করা হয়েছে সিপিটিইউর কাছে। এগুলো বাস্তবায়ন করা হলে মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠান সব ঠিকাদারি পাবে না। ছোট কিংবা বড় নয়, যোগ্য প্রতিষ্ঠান ঠিকাদারি পাবে।

সওজ সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটিতে নিবন্ধিত ঠিকাদারের সংখ্যা ৮৪৫। বর্তমানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ২৩২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১টি প্রকল্পে ২২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার কাজ করছে। এর অর্ধেক ১১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার কাজ করছে সাতটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। শীর্ষ ২০ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করছে ১৮ হাজার কোটি টাকার কাজ। অবশিষ্ট সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার কাজ করছে ২১২টি প্রতিষ্ঠান। বড় সাত প্রতিষ্ঠানের গড়ে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি কাজ চলমান রয়েছে। ছোট ২১২ প্রতিষ্ঠানের গড়ে ২১ কোটি টাকার কাজ রয়েছে। ৬১৩টি প্রতিষ্ঠানের হাতে কোনো কাজ নেই।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠানো চিঠিতে সওজ বলেছে, এ কারণে ছোট ঠিকাদারদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। সওজের নিজস্ব সভায় প্রস্তাব করা হয়েছে, ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রকল্পের কাজগুলো ই-জিপিতেই সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে (এলটিএম) আহ্বান করা প্রয়োজন। তবে এলটিএম লটারিতে অযোগ্য ঠিকাদারের কাজ পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য এ প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে সওজ কর্মকর্তাদের।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, দরপত্রে অনিয়ম ঠেকাতে নানা শর্ত যোগ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেগুলোই সমস্যা সৃষ্টি করছে। ইলেক্ট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) করা হয়েছিল দরপত্র প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে। কিন্তু এখন 'সরিষায় ভূত' দেখা দিয়েছে। সওজ সূত্র জানা গেছে, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠাগুলোর সক্ষমতা মূল্যায়নে (অ*১.৫*ঘ-ই) ফ্যাক্টর ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ একজন ঠিকাদার বিগত পাঁচ বছরে যত প্রকল্পের কাজ করেছে তার মূল্যের (অ) দেড়গুণ টাকার কাজ করার সক্ষমতা রাখে। অর্থাৎ কোনো ঠিকাদার বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে ১০০ কোটি টাকার কাজ করলে তার প্রতিষ্ঠান ১৫০ কোটি টাকার কাজের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে। তার কতটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে তা বিবেচিত হবে না। এছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরি সামর্থ্যের কারণে এই ফ্যাক্টর দ্বিগুণ বা তার বেশিও ব্যবহূত হয়। এ কারণে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পেয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা বঞ্চিত হচ্ছে। এ সমস্যা নিরসনে 'টেন্ডার ক্যাপাসিটি ফর্মুলায় ফ্যাক্টরটি ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ২৫ করার সুপারিশ করেছে সওজ।

এছাড়াও দরপত্র মূল্যায়নে বিগত পাঁচ বছরের কাজের মূল্যায়ন নম্বর ১০০ এবং চলমান কাজের নম্বর কমিয়ে ৬০ করার প্রস্তাব করেছে সওজ। বর্তমান নিয়মে দরপত্র মূল্যায়নে অতীতে করা কাজের (পাস্ট পারফরম্যান্স ম্যাট্রিক্স) মূল্যের ৭৫ শতাংশ ঊর্ধ্বসীমা বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক কোটি টাকার কাজে একই দর (একই পরিমাণ টাকা) প্রস্তাব করলে, যে প্রতিষ্ঠান বিগত পাঁচ বছরে ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত যত কাজ করেছে তা সব বিবেচনায় আসবে। সে ঠিকাদার মূল্যায়ন নম্বর পাবে। নিম্নসীমা না থাকায় ছোট ছোট কাজও মূল্যায়নে চলে আসে। এতে যে ঠিকাদার অতীতে বেশি কাজ করেছে, সেই নতুন কাজ পাচ্ছে। এ কারণে মাইনাস ৭৫ ভাগ নিম্নসীমা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। ফলে এক কোটি টাকার দরপত্রে অতীতে করা ২৫ লাখ টাকার কমের প্রকল্প বিবেচনায় আসবে না।

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লাগার কারণে একই সময়ে অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন থাকা অন্য দরপত্রের বিষয়টি মূল্যায়নে আসে না। অর্থাৎ অন্য যেসব কাজ ওই প্রতিষ্ঠান পেতে যাচ্ছে, তা মূল্যায়নে আসে না। এ কারণে একটি প্রতিষ্ঠান একই সময়ে একাধিক কাজ পেয়ে যায়।

এসব সমস্যা নিরসনে গত ডিসেম্বরে সওজের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী কাজী শাহারিয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে সংস্থাটির 'সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট কমিটি'র সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভা সূত্রে জানা গেছে, দরপত্রে আরেকটি সমস্যা হলো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশি প্রতিষ্ঠানের 'যৌথ উদ্যোগ' (জেভি)। এ প্রক্রিয়ায় অযোগ্য প্রতিষ্ঠান বিদেশি বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জেভি করে তার সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার কাগজ ব্যবহার করে। এসব কাগজ 'ভাড়া'য় আনা হয়। ভাড়ায় আনা সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার কাগজ দিয়ে কাজ পেয়ে যায় অযোগ্য প্রতিষ্ঠান। অনেক ক্ষেত্রেই যে প্রতিষ্ঠান আসলে কাজ পেয়েছে তার অংশীদারিত্ব থাকে মাত্র দুই থেকে পাঁচ শতাংশ। এ সমস্যা নিরসনে জেভিতে অংশীদারিত্বের সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে সওজ। এ পদ্ধতিতে একাধিক প্রতিষ্ঠান জেভি করে দরপত্রে অংশ নিলে, সেখানে ছোট প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকতে হবে।

মুষ্টিমেয় ঠিকাদার যেন সব কাজ না পায় এবং যেসব প্রতিষ্ঠান কাজের মান বজায় রাখতে পারছে না- তারা একটি কাজ শেষ করা না পর্যন্ত আরেক কাজ যেন না পায়, প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সিপিটিইউর সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহ স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে ক্রয় আইন (পিপিএ-২০০৬), ক্রয়বিধি (পিপিআর-২০০৮), আদর্শ দরপত্র দলিল (জিসিসি) এবং চুক্তির বিশেষ শর্তাবলি (পিসিসি) বিষয়ে করণীয় বলা হয়েছে।

সিপিটিইউ ইতোমধ্যে টেন্ডার ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর ১ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ১ দশমিক ২৫ করতে এবং ফাস্ট পারফরম্যান্স ম্যাট্রিক্সের নিম্নসীমা মাইনাস ৭৫ শতাংশ করতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সওজ কর্মকর্তারা। সওজের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ক্রয়) মোহাম্মদ সাব্বির হাসান খান বলেছেন, সিপিটিইউ যেসব শর্ত ও নিয়মকানুন দিয়েছে, তা দরপত্রে স্বচ্ছতার জন্যই। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা দেখা দিয়েছে। এ কারণেই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সব কাজ পেয়ে যাচ্ছে।

কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে কম দর প্রস্তাব করে কাজ পেয়ে যাচ্ছে কারিগরি যোগ্যতা না থাকা প্রতিষ্ঠান। তা ঠেকাতে 'এক ধাপ দুই খাম' পদ্ধতির প্রস্তাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন সাব্বির হাসান খান। তিনি বলেছেন, এ পদ্ধতিতে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদার প্রথম খামে তার প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, জনবল ও কারিগরি তথ্য দেবেন। দ্বিতীয় খামে দর প্রস্তাব করবেন। প্রথমে প্রথম খাম খোলা হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান কারিগরি সক্ষমতা ও জনবলের দিক দিয়ে যোগ্য বিবেচিত হবে, শুধু সেগুলোরই দরপ্রস্তাবের দ্বিতীয় খাম খোলা হবে। এতে অযোগ্য প্রতিষ্ঠান কম দর প্রস্তাব করে কাজ পাবে না।

সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেসব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে অনেক প্রকল্পে কাজ করছে, তারা একই যন্ত্রপাতি ও জনবল একাধিক জায়গায় ব্যবহার করে। ফলে কাজ ঠিকঠাক হয় না। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ হয় না। এ কারণে যন্ত্রপাতি ও জনবল নিয়োগের সময়সীমা দরপত্রের শর্তে জুড়ে দেওয়ার চিন্তা রয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য যে প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা নিজস্ব জনবল ও যন্ত্রপাতি নিয়োগ করবে তাকে অধিক নম্বর দেওয়ার প্রস্তাব করেছে সওজ। ফলে একই যন্ত্রপাতি ও লোকবল দিয়ে একাধিক কাজ বন্ধ হবে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/210252211/