৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১২:৪১

করোনা পরিস্থিতির সঠিক চিত্র নেই কারো হাতে

দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত তথা আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে। অন্যদিকে সারা দেশে করোনাভাইরাসের টিকাও দেওয়া শুরু হয়েছে। ফলে যদি দুর্ভাগ্যক্রমে ইউরোপের মতো কোনো উল্টো পরিস্থিতি না ঘটে, তবে আপাতদৃষ্টিতে দেশের মানুষের কাছে করোনাকালের বিদায় সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তবে করোনা বিদায় নিলেও দেশে মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষ প্রকৃতপক্ষে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল, এর কোনো সঠিক তথ্য বা চিত্র এখন পর্যন্ত নেই কারো কাছেই। ফলে ভবিষ্যতে করোনাসংক্রান্ত কোনো গবেষণা বা পর্যালোচনারও উপযুক্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত থাকছে না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরাই।

এ ছাড়া এখনো অ্যান্টিবডি টেস্টের জট না খোলা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর অসন্তোষ। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও কেন এটি চালু হচ্ছে না বা কবে নাগাদ হবে, তা-ও ঠিক করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

অবশ্য গত ১২ অক্টোবর সরকারের আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, ঢাকায় বস্তিতে ৭৪ শতাংশ ও বস্তির বাইরে ৪৫ শতাংশ মানুষের দেহে অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়, যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল। আক্রান্তদের ৮২ শতাংশই ছিল উপসর্গহীন। কভিড-১৯-এর প্রিভিলেন্স, সেরোসার্ভেইল্যান্স ও জিনোমিক ইপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভের ফল অবহিতকরণ অনুষ্ঠানে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল। তখন জানানো হয়, ঢাকায় বস্তির বাইরে করোনায় আক্রান্ত উপসর্গধারী ৩৩৩ জন ও উপসর্গহীন ৩৫৯ জন এবং বস্তি এলাকার ৩৬ জন উপসর্গধারী ও ৮৯ জন উপসর্গহীন করোনা আক্রান্তের অ্যান্টিবডি টেস্ট করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। যদিও ওই অনুষ্ঠানেই আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এবং আইইডিসিআরের বর্তমান পরিচালক ড. তাহমিনা শিরিন জানিয়েছিলেন—এই পরিসংখ্যান পুরো ঢাকাবাসীকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তবু ওই তথ্য প্রকাশের পর এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা হয়। এর পরপরই আইইডিসিআর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়—শিগগিরই বড় আকারে আরেকটি পর্যবেক্ষণের কাজ করে এর ফলাফল জানানো হবে এবং তা গবেষণার জন্য সংরক্ষণ করা হবে।

গতকাল সোমবার আইইডিসিআরের পরিচালক ড. তাহমিনা শিরীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের পরে আমরা বড় আকারে আরেকটি পর্যবেক্ষণ চালিয়েছি, যার ফলাফল প্রস্তুত হচ্ছে। তবে এবারের পর্যবেক্ষণেও আগের ফলাফলের খুব একটা হেরফের হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এখন করোনা সংক্রমণ একেবারেই নিচের দিকে। তবু দেশে ঠিক কত শতাংশ মানুষ প্রকৃত অর্থে আক্রান্ত হয়েছিল, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র আমরা জানি না। এটা না জানলে ভবিষ্যতে এসংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা সঠিক হবে না। তাই দেশে একাধারে দুই-তিন পর্যায়ের গবেষণা বা পর্যবেক্ষণ করে শনাক্তের গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত বের করা দরকার, যেটায় বেশ ঘাটতি আছে। এ ক্ষেত্রে এখনো দেশে অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু না হওয়ার বিষয়টি ভালো হচ্ছে না। এটা করা জরুরি।’

এদিকে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অ্যান্টিবডি টেস্ট চালুর অনুমোদন দেওয়া হবে জানালেও এখন পর্যন্ত এর কোনোটিরই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বরং বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার কোনো দিকনির্দেশনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলতে পারছেন না।

আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী দেশে অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদনের কথা বললেও এটা নিয়ে এখনো পরবর্তী কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া এখন সবাই যেহেতু টিকা কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত, তাই এই বিষয় হয়তো কিছুটা পেছনে পড়ে গেছে।’ যারা আগে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল, তাদের অ্যান্টিবডি টেস্ট না করেই টিকা দেওয়ার বিষয়ে এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে সবার অ্যান্টিবডি টেস্ট করার দরকার নেই। আমরাই গবেষণার আওতায় এই টেস্ট করব। এখনো প্রাইভেটে অ্যান্টিবডি টেস্ট চালুর অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।’

ড. শিরীন বলেন, টিকা দেওয়ার পরপরই টেস্ট করার বা অ্যান্টিবডি দেখার কোনো দরকার নেই। এটা করতে চাইলে করতে হবে চার-ছয় সপ্তাহের মাথায়। যারা আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছে, তারাও টিকা নিতে পারবে, কোনো সমস্যা নেই। তবে ঠিক বোঝা যাবে না টিকার অ্যান্টিবডি কী রকম হলো আর টিকা নেওয়ার আগে করোনামুক্তির পর কী রকম অ্যান্টিবডি ছিল। আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, ‘সর্বশেষ পর্যবেক্ষণেও আমরা দেখছি, দেশে গড়ে ৯ শতাংশ মানুষ হয়তো করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।’

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার পাঠানো নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির তথ্যসূত্র অনুসারে দেখা যায়, দেশে এ পর্যন্ত ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে এর মধ্যে সর্বশেষ হিসাব অনুসারে ১৪.৩১ শতাংশের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে। জনসংখ্যার তুলনায় প্রতি ১০ লাখের মধ্যে আক্রান্ত হিসাবে শনাক্তের সংখ্যা তিন হাজার ১৬১ জন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন বিশেষজ্ঞ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যদি ১৮ শতাংশও হিসাব করি, আর মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরে হিসাব করি, তাহলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল। যদিও আমাদের ধারণা, এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। এ জন্যই সঠিক গবেষণা জরুরি।’ এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘প্রতিবেশী ভারতে এখন মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৩৮ কোটি। এর মধ্যে দেশটির প্রায় ৩০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে; যা জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ। আর আমাদের এখানে ১৪ শতাংশ হলে সেটা অমূলক নয়। কারণ ভারতের মতো এতটা ব্যাপক সংক্রমণ আমাদের দেশে ছিল না।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/02/09/1003093