৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১২:৪০

এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

অচল ৪৫ ধরনের সরঞ্জাম

দীর্ঘদিন ধরে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসাসেবা ব্যাহত - ২২ প্রকারের যন্ত্রের ক্রয় পরবর্তী সেবা দেয়নি - ব্যবহার না করায় দুটি মেশিন নষ্ট - লিখিত দেওয়ার পর ব্যবস্থা নেয়নি নিমিও -পরিচালক - দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে -মহাপরিচালক

সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দিনাজপুর। এই হাসপাতালের ৪৫ ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জাম সর্বোচ্চ ৫ বছর ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে ২২ ধরনের মেশিনে কোনো ধরনের সার্ভিস দেয়নি সরবরাহকারী কোম্পানি। দুটি মেশিন ব্যবহার না হওয়ায় পড়ে পড়ে বিকল হয়ে গেছে।

বাকিগুলো পুরনো। যন্ত্রের অভাবে এ হাসপাতালে গুরুত্বপূর্ণ রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। সরঞ্জামগুলো সচল না থাকায় হৃদরোগ, নানা ধরনের অস্ত্রোপচার, দন্ত চিকিৎসা, আইসিইউ চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি যন্ত্রগুলো অচল পড়ে থাকায় সাধারণ রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে সিটিস্ক্যান, এমআরআই পরীক্ষাও হচ্ছে না। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব ওই হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে এমন প্রতিবেদন দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবেদনে অচলের তালিকায় রয়েছে হৃদরোগ বিভাগের সব গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম। এতে বোঝা যায় এই হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। একইভাবে সব অ্যানালাইজার, এক্সরে, সিটিস্ক্যান ও এমআরআই মেশিন অচল থাকায় রোগীদের প্রায় সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই বন্ধ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

এ বিষয়ে কথা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, বিষয়টি তিনি জানেন। তিনি নিজেও এই হাসপাতাল একাধিকবার পরিদর্শনে গিয়েছেন এবং এসব অচল চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো দেখেছেন। পরিদর্শন শেষে নিয়মানুযায়ী তিনি ন্যাশনাল ইলেক্ট্রো-মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট মেইন্টেনেন্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেইনিং সেন্টারে (নিমিও এন্ড টিসি) লিখিতভাবে জানিয়েছেন। ডা. ফরিদ বলেন, একাধিকবার জানানোর পরেও নিমিও থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

গত বছরের ২৯ নভেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (নার্সিং ও মিডওয়াইফারি) মনোজ কুমার রায় অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল) এর দফতরে এই প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে ৪৫ ধরনের ৯৬টি মেশিন অচল বলে উল্লেখ করেন। যার মধ্যে ২২ ধরনের সরঞ্জামের বিষয়ে মন্তব্য করা হয়েছে, মূল কোম্পানি সার্ভিস প্রদান করেনি।

অর্থাৎ যে প্রতিষ্ঠান মেশিন সরবরাহ করেছে তারা কোনো ধরনের সার্ভিস দেয়নি। ডায়ালাইসিস মেশিনের ক্ষেত্রে মন্তব্য করা হয়েছে, স্থান সংকট এবং ডেন্টাল সিটিস্ক্যান মেশিনের ক্ষেত্রে লেখা হয়েছে জনবল সংকট ও ইউজার ফি নির্ধারণ না থাকা। আর বাকিগুলোর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মেশিনগুলো অধিক পুরনো এবং মেরামত অলাভজনক।

তালিকায় দেখা গেছে, যেকোনো ধরনের জটিল শারীরিক পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত এমআরআই মেশিনটি অচল ৩ বছর ধরে। মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহৃত সিটি স্ক্যান মেশিনটি অচল দু’বছর। হাসপাতালের তিনটি এক্সরে মেশিন অচল এক বছর। পেটের ভেতরের বিভিন্ন অংশের রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত চারটি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন অচল ৪ বছর ধরে। একইভাবে খাদ্যনালি, পাকস্থলী ইত্যাদির পরীক্ষায় ব্যবহৃত এন্ডোস্কপি মেশিন অচল দুই বছর ধরে।

পরিদর্শন তালিকায় একটি বিরল ধরনের চিকিৎসা যন্ত্রের উল্লেখ করা হয়েছে, ডেন্টাল সিটি স্ক্যান মেশিন। দেশের বেশিরভাগ হাসপাতালে এ ধরনের মেশিন নেই। তবে এই মেশিনটি কখনো ব্যবহার হয়নি, তাই অচল পড়ে আছে ৪ বছর ধরে। এছাড়া ডেন্টাল দুটি ইউনিট অচল ৪ বছর, তিনটি ডেন্টাল স্কেলার অচল ২ বছর ধরে। অর্থাৎ এই হাসপাতালে দাঁতের কোনো রোগীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।

তালিকায় পরিদর্শন কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, সিটি এনজিওগ্রাম মেশিন নষ্ট এক বছর। দুটি ইকো কার্ডিওগ্রাফি মেশিন নষ্ট দুই বছর, দুটি ইসিজি মেশিন নষ্ট ৩ বছর ধরে। অর্থাৎ এই হাসপাতালে হৃদরোগ নিয়ে আসার কোনো রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পর্যায়ের কোনো চিকিৎসায় দেওয়া সম্ভব হবে না। এমনকি তার হৃদযন্ত্রের তাৎক্ষণিক অবস্থা বোঝাও সম্ভব হবে না।

হাসপাতালটির জটিল রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাও বেশ নাজুক। তিনটি ডায়ালাইসিস মেশিন অচল পড়ে আছে। তীব্র শ্বাসকষ্টের রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত একটি সি-প্যাপ, ৭টি স্যাকার মেশিন অচল ২ বছর ধরে।

এমনকি ৫টি নেবুলাইজার মেশিন অচল ২ বছর, ২টি মনিটর অচল ৮ মাস ধরে, ৪টি সিরিঞ্জপাম্প অচল পড়ে আছে ২ বছর ধরে, দুটি পোর্টেবল পালস অক্সিমিটার অচল ৬ মাস ধরে। এমনকি রোগীর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র ৪টি ভেন্টিলেটর মেশিনও গত ৬ মাস ধরে অচল পড়ে আছে। অর্থাৎ ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর হঠাৎ অবনতি ঘটলে তাকে বাঁচানোর শেষ অবস্থাটিও নেই।

তালিকায় দেখা যায়, ৪টি অটোক্লেভ মেশিন অচল ২ বছর ধরে, দুটি ওটি টেবিল নষ্ট দু’বছর ধরে, ৫টি ডায়াথার্মি নষ্ট ২ বছর ধরে, একটি অ্যানেসথেশিয়া মেশিন অচল ২ বছর, একটি সি-আর্ম মেশিন অচল ১ বছর। অর্থাৎ ওটি টেবিল নষ্ট মানে অস্ত্রোপচার বন্ধ। অটোক্লেভ অচল মানে কোনো যন্ত্রপাতিই জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা সেখানে নেই। আর অ্যানেসথেশিয়া মেশিন অচল থাকার অর্থ কোনো রোগীর শল্য চিকিৎসা করার সুযোগই সেখানে নেই।

সবচেয়ে নাজুক অবস্থা হাসপাতালের রোগ নির্ণয় ব্যবস্থায়। হাসপাতালের দুটি মাইক্রোসকোপ অচল ২ বছর ধরে। দুটি ফার্মাসিউটিক্যাল ফ্রিজ অচল ২ বছর, দুটি মাইক্রো প্লেট রিডার অচল ২ বছর ধরে, ৫টি সেন্ট্রিফিউজ অচল ২ বছর। একটি ইমিওনোলজি সিসটেম অচল প্রায় এক বছর, ৩টি ইউরিন কেমিস্টি অ্যানালাইজার অচল ৬ মাস, একটি ইউরিন ল্যাব অটোমেশন ইউএক্স-২০০০ মনিটর অচল ৬ মাস।

একটি হেমাটোলজি সেল সেন্টার অচল প্রায় ৮ মাস, একটি কমপ্যাক্ট ব্লাড কজুলেশন অ্যানালাইজার অচল ৯ মাস, একটি সেল কাউন্টার অচল ৫ বছর। হাসপাতালের একটি বায়োকেমিস্ট্রি অটো অ্যানালাইজার অচল ৫ বছর, একটি ইএসআর এস্টিমিশন মেশিন এক্সসিএ অচল ৫ বছর।

একটি হেমাটোলজি অটো অ্যানালাইজার স্লাইড পার্ট অচল ৫ বছর, একটি ইলেক্ট্রপ্রসিস অ্যানালাইজার ভি-৮ অচল ৫ বছর, ইলেক্ট্রপ্রসিস মেশিন অচল ৫ বছর, তিনটি সেমিঅটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার অচল ৩ বছর। একটি সিপি ইমিউনোসিস সিসটেম অচল ৫ বছর, দুটি ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজার অচল দুই বছর। অর্থাৎ এই হাসপাতালে রক্ত, মল, মূত্র সব ধরনের পরীক্ষাই এক প্রকার হচ্ছে বলা চলে।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেউ তার নজরে আনেননি। যুগান্তরের মাধ্যমেই তিনি এ বিষয়ে জানতে পেরেছেন। তিনি দ্রুত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/391669/