৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১১:০৮

কাজই শুরু হয়নি তবুও ব্যয় বাড়ছে

২ বছর ৮ মাসে বাস্তব কোনো অগ্রগতি নেই; অনুমোদনের দু’বছর আগে পরামর্শক নিয়োগ; অভ্যন্তরীণ শোভাবর্ধনে প্রায় ২০ কোটি টাকা

অনুমোদিত দু’বছরে প্রকল্পের কোনো কাজই শুরু করা হয়নি। এরই মধ্যে মেয়াদ বাড়ানো হলো। তাতেও কাজ শুরু করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণপূর্ত অধিদফতর। কাজই শুরু হয়নি, অথচ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকা। অনুমোদনের পরই প্রকল্পের কাজের নকশা ও বিভিন্ন কাজের খাত পরিবর্তন ও সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পে কোনো অগ্রগতি না থাকলেও খরচ হয়েছে দুই কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। দু’বছরের প্রকল্প এখন চার বছরে দাঁড়াচ্ছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো সূত্রে জানা গেছে। প্রকল্প অনুমোদনের দুই বছর আগেই পরামর্শক নিয়োগ, শোভা বর্ধনেই যাবে ২০ কোটি টাকা, সোয়া চার কোটি টাকার বেশি খরচে সুইমিংপুল নির্মাণ, পরামর্শক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আর্থ-সামাজিক বিভাগ।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত প্রস্তাবনার তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় জয়িতা টাওয়ার নির্মাণের জন্য ১৫৪ কোটি ২৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল। প্রকল্পের উদ্দেশ্য, ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধাসহ ঢাকায় জয়িতা ফাউন্ডেশনের জন্য সদর দফতর নির্মাণ এবং সুবিধাবঞ্চিত নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নারীবান্ধব বিপণন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে দু’টি বেজমেন্টসহ ১২ তলা বিশিষ্ট জয়িতা নির্মাণ করা। দু’বছরে বাস্তবায়নের এই প্রকল্পটি ২০২০ সালের মার্চে সমাপ্ত করার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শুরু করা যায়নি বলে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক বছর। কিন্তু দুঃখজনক যে ২ বছর ৮ মাস অতিক্রম করেছে প্রকল্পের বাস্তব কোনো অগ্রগতি নেই। এখন মেয়াদ আরো দু’বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত করার প্রস্তাব দিয়ে প্রকল্প সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই সাথে খরচ ১৯ কোটি ৪৪ লাখ ৪২ হাজার বাড়িয়ে ১৭৩ কোটি ৬৯ লাখ ১৭ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় মূল কার্যক্রম ছিল, ভবন নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, সাইট অফিস, ড্রেন, সীমানা দেয়াল নির্মাণ, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও বৃষ্টির পানি সংক্ষেণ ব্যবস্থা স্থাপন, আসবাবপত্র ক্রয়, যানবাহন ক্রয়, পরামর্শক সেবা ক্রয় এবং অন্যান্য কাজ।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ২ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। এর বিপরীতে বাস্তব অগ্রগতি নেই। প্রকল্পের মেয়াদ প্রথম পর্যায় পার করে ভবনের নকশা সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। নতুন করে জয়িতা টাওয়ার ভবনে একটি ল্যান্ডিং লেভেলসহ মোট পাঁচটি বেজমেন্টের পরিবর্তে দু’টি বেজমেন্ট থাকবে। কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ যন্ত্র থাকবে না। তার পরিবর্তে ভেরিঅ্যাবেল রেফ্রিজেরেন্ট ফ্লো (ভিআরএফ) সিস্টেম থাকবে। টাওয়ারে কোনো সিনেপ্লেক্স থাকবে না। তবে একটি মাল্টিপারপাস হলরুম থাকবে। ভবনে ডরমেটরির পরিবর্তে বিশ্রাম কক্ষ থাকবে। টাওয়ারের তিন দিকে বারান্দা থাকবে। টাওয়ারের প্রবেশপথ বাগান সমৃদ্ধ সবুজ বেষ্টনী দ্বারা সুশোভিত হবে। ভবণ নির্মাণে যাবে প্রায় ৯৬ কোটি টাকা। আর ভবনের ভেতরে শোভা বর্ধনেই খরচ ১৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ বলেছে, আরডিপিপি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পটি এপ্রিল ২০১৮ থেকে মার্চ ২০২০ মেয়াদে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে এর আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা বা ১.৪৩ শতাংশ। তবে কোনো বাস্তব অগ্রগতি নেই। এখনো প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু না হওয়ার কারণ জানা প্রয়োজন।

অভ্যন্তরীণ শোভবর্ধন খাতে ১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। যা নতুন করে যুক্ত করা হয়ছে। এই খাত সংযুক্ত করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমান নকশা অনুযায়ী ভবনটিতে কোনো সিনেপ্লেক্স তাকবে না বলা হরেও ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় দু’টি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। ৪ কোটি ১৮ লাখ ৭ হাজার টাকা ব্যয়ে টাওয়ারে সুইমিংপুল নির্মাণের যৌক্তিকতা কী? অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন দেখানো হলেও আরডিপিপিতে এটি নেই। প্রকল্পটি ২০১৮ সালে অনুমোদিত হলেও পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২০১৬ সালে। আর পরামর্শক খাতে ব্যয় ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ছিল। সেটা বাড়িয়ে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। বিভিন্ন সভার সম্মানী খাতে খরচ ধরা হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা, যা অত্যাধিক বলে পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে।

প্রকল্পের অগ্রগতি ও সার্বিক বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (যুগ্মসচিব) শহীদুল ইসলামের কাছে গতকাল ফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রকল্পটি তিন বছরে সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা শেষ হয়নি। যেহেতু প্রকল্পের ভৌত কাজ অর্থাৎ ভবন নির্মাণকাজ শুরুই হয়নি তাই এর বাস্তব কোনো অগ্রগতি নেই। তিনি বলেন, এখানে একটা বিল্ডিং নির্মাণ করা হবে। মাঝপথে এসে ডিজাইন চেঞ্জ হয়েছে। বিল্ডিংয়ের নির্মাণই শুরু হয়নি। আজ সোমবার পিইসি সভায় যদি অনুমোদন হয় তাহরে কাজ শুরু হবে হয়তো। ২ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেতন ভাতা, গাড়ি ও কিছু কম্পিউটার কেনা হয়েছে। এই জন্য সামান্য কিছু খরচ হয়েছে।

পরামর্শক নিয়োগ প্রকল্প অনুমোদনের দুই বছর আগে হয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো হতেই পারে। একটা বিল্ডিং তৈরির আগে ডিজাইন করতে হয়। সেই ডিজাইন করার জন্য একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেখান থেকে ডিজাইন নির্বাচন করা হয়েছে। সে কারণে পরামর্শক নিয়োগ ২০১৬ সালে করা হয়। এতে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি। ডিজাইন তৈরি করেই তো ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। আর সেটা তো বানানোর আগেই করতে হবে। ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে সুইমিংপুল নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শহীদুল ইসলাম বলেন, এটা বিল্ডিংয়েই ইনডোর সুইমিংপুল হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/561241/