৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১১:০৭

মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ার আশঙ্কায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে সরকার

সরকার চলতি অর্থবছরের শুরুতে জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল, যা সম্প্রতি সংশোধন করে ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিগগির বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির ওপর কিছুটা চাপ আসবে। সেই হিসেবে দেশেও মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার চাল আমদানির ওপর শুল্ক কমানোয় মূল্যম্ফীতি কিছুটা নিম্নমুখী রয়েছে। চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশের মধ্যে থাকবে। এদিকে চলতি অর্থবছরে করোনাভাইরাস সঙ্কটে অর্থের জোগান বাড়াতে রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) ও রিভার্স রেপোর সুদহার আরও এক দফা কমিয়ে ‘সম্প্রসারণমুখী’ নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধেও (জানুয়ারি-জুন) বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হলেও নীতিনির্ধারণী সুদের হার ও কৌশলে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনা হয়নি।

জানা যায়, করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে গত বছরের ২৯ জুলাই ২০২০-২১ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল, তাতে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ। সংশোধন করে তা ১৭ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। মুদ্রানীতির এই পরিবর্তনে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ করা হয়েছে। মনিটারি পলিসি কমিটির ৫০তম সভায় ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে এ সব পরিবর্তনসহ আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনীতির সামষ্টিক চলকসমূহের সর্বশেষ পরিস্থিতি (আউটকাম) ও স্বল্প মেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি (আউটলুক) পর্যালোচনা করে চলতি অর্থবছরের ঘোষণা করা সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত রেখে অবশিষ্ট সময়ের জন্য মুদ্রা ও ঋণ কর্মসূচিতে মধ্য-মেয়াদী পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রকাশিত সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুক (জানুয়ারি ২০২১), বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন, বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের মাসিক চিত্র (ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত) এবং রয়টার্স প্রকাশিত দৈনিক (২১ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত) স্বর্ণ ও অপরিশোধিত তেলের দামের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে মনিটারি পলিসি কমিটির সভায় এই মত প্রকাশ করা হয় যে “কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব কাটিয়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ২০২১ সালের মধ্যে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির প্রকৃত খাতের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্তের পর্যালোচনা, আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক চাহিদা পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ইকোনোমিক মডেলিং অ্যান্ড ফোরকাস্টিং অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সরকারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৪ শতাংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে, যা বছরের শুরুতে ৮ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল।

বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘের এফএও প্রকাশিত পণ্যের (এনার্জি ও নন-এনার্জি) মূল্যসূচক এবং খাদ্য (চালসহ) মূল্যসূচকের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সভায় বলা হয়, নিকট ভবিষ্যতে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে। সে হিসেবে দেশেও মূল্যস্ফীতির উপর চাপ আসতে পারে। সরকার ইতোমধ্যে চাল আমদানির ওপর থেকে শুল্ক কমানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিন্মমুখী এবং আপাতত চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকবে।

গত ডিসেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণ জানা যায়, রেমিটেন্স অন্তঃপ্রবাহের জোরালো প্রবৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ার কারণে চলতি অর্থবছরে নিট বৈদেশিক সম্পদ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায়, সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অব্যাহত রেখেই নিট বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি এবং নিট অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে চলতি অর্থবছরের মুদ্রা ও ঋণ কর্মসূচিতে মধ্য-মেয়াদে পরিবর্তন আনা সমীচীন হবে।

সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনায় অর্থনীতিতে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির নিরাপদ সীমাও কিছুটা সংশোধন করে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে করোনা ভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে নিকট ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। মুদ্রানীতির মুদ্রা ও ঋণ কর্মসূচিতে মধ্যমেয়াদে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বৈদেশিক লেনদেন খাতের সম্ভাব্য গতিধারা বিবেচনা করে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের অন্যতম উপাদান ব্যাংক ব্যবস্থার নিট বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। তা সংশোধন করে ২০ দশমিক ১ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া নীট অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ করা হয়েছে। আর ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাত থেকে সরকার কম ঋণ নিচ্ছে। আর বেসরকারি খাত থেকে কম নিলেও আরও বেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। তাই বেসরকারি খাতের ঋণ কর্মসূচিতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে, চলমান মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা এবং সরকার নির্ধারিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে আর্থিক খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করা।
২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতির লক্ষ্য পূরণে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকেই কিছু ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার জায়গা চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ মহামারির দীর্ঘসূত্রতা ও অনিশ্চয়তার কারণে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পুনরুদ্ধারের গতি-প্রকৃতি বাধাগ্রস্ত হওয়া। বৈশ্বিক চলমান অর্থনৈতিক মন্দার দীর্ঘসূত্রতার কারণে দেশের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের অন্তঃপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাসহ বেশ কিছু ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। চলতি বছরেও কবে নাগাদ সবকিছু স্বাভাবিক হবে তার কোনো ঠিক নেই। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ৭ দশমিক ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব হবে না যদি করোনার টিকা বাংলাদেশ ঠিকমতো প্রয়োগ শুরু করতে পারে।

জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয় ৫ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২০০৯-১০ তা কিছুটা বেড়ে হয় ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে হয় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ২০১১-১২ অর্থবছরে হয় ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে হয় ৬ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে হয় ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে হয় ৭ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হয় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হয় ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ১৫ ভাগ। টাকার অঙ্কে জিডিপির আকার ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। আর বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও গেল ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। স্থিরমূল্যে এ জিডিপির আকার ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফ মনে করে, করোনা পরিস্থিতি কতটা দীর্ঘায়িত হবে, এর ওপর নির্ভর করে প্রবৃদ্ধি কত হবে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারিরূপে ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে চলতি বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশে নেমে আসবে বলে আভাস দিয়েছিল।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, প্রবৃদ্ধি যেসব খাত থেকে আসে, তার প্রত্যোকটা খাতই কম-বেশি করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে আছে। খরচের দিক থেকে অর্থাৎ চাহিদার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রপ্তানি খাত। করোনাভাইরাসে বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্দার দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বিশ্ব বাণিজ্য খারাপ হওয়ার কারণে গার্মেন্ট পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। তখন চাহিদা থাকলেও তা সরবরাহে সক্ষমতার ঘাটতি তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, যেখানে বেশি কর্মসংস্থান হয়, বেশি মজুরি দিয়ে কর্মসংস্থান হয় সেটা শিল্প খাত। এই রপ্তানিমুখী খাতের ঝুঁকি বাড়ছে। শিল্প উৎপাদন, গার্মেন্ট এবং চামড়া খাত ছাড়াও ফুটওয়্যার, অ্যাগ্রোপ্রসেসিং, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে চাহিদা দুর্বলতায় উপাদান সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে উৎপাদন।

https://dailysangram.com/post/443078