মেট্রোরেল (এমআরটি-৬) লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ানো এবং স্টেশন নির্মাণকে কারণ দেখিয়ে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা কমলাপুর স্টেশন ভেঙে স্থানান্তর করতে চায় রেলপথ মন্ত্রণালয়। কিন্তু মেট্রোরেলের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বলছে, তাদের প্রকল্পের কারণে কমলাপুর স্টেশন ভাঙার প্রয়োজন নেই। স্টেশন ভাঙার চিন্তা রেলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণাধীন মেট্রোরেল লাইনকে কমলাপুর পর্যন্ত বাড়ানো এবং সেখানে মেট্রোর এলিভেটেড (উড়াল) স্টেশন নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কমলাপুর স্টেশন ভাঙায় সম্মতি দিয়েছে। গত ১৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। মেট্রোরেলের জন্য প্রয়োজন না থাকলেও কী উদ্দেশ্যে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনা ভাঙা হচ্ছে, তার কোনো সদুত্তর মেলেনি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেছেন, কমলাপুর রেলস্টেশন ভাঙার এ পরিকল্পনা থেকে সরকারের সরে আসা উচিত।
জাপানের অর্থায়নে (জিটুজি) সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) প্রকল্পগুলোর পর্যালোচনায় অনুষ্ঠিত ওই সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, 'কমলাপুর স্টেশন বিল্ডিংয়ের আগে এমআরটি-৬-এর সিজর ক্রসিংয়ের স্থান সংকুলান করার জন্য এমআরটি-৬-এর প্ল্যানে স্টেশন বিল্ডিং উত্তর দিকে স্থানান্তর করা হবে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং ডিএমটিসিএল সম্মত হয়েছে।'
জাপানের অর্থায়নে পিপিপিতে নান্দনিক স্থাপনা কমলাপুর স্টেশনকে 'মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব'-এ রূপান্তরের উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্পের নথি সূত্রে জানা গেছে, 'মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব' হাইস্পিড ট্রেন, মেট্রোরেল, পাতাল রেল এবং এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করবে। এখান থেকে রাজধানীর যে কোনো প্রান্তে যাওয়া যাবে। 'মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব' ঘিরে থাকবে হোটেল, বিনোদন কেন্দ্রসহ নানা বাণিজ্যিক স্থাপনা। জাপানের কাজিমা করপোরেশন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। একই সংস্থা বিমানবন্দর স্টেশনকেও 'মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব'-এ রূপান্তরের দায়িত্ব পেয়েছে।
২০১৯ সালের ২১ মার্চ কাজিমা করপোরেশনের প্রকল্প ধারণাগত প্রস্তাব তৃতীয় বাংলাদেশ-জাপান পিপিপি সভায় অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) চলতি মাসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
কিন্তু রেলের দাবি, মেট্রোরেলের জন্য কমলাপুর স্টেশন ভাঙতে হবে। কমলাপুর স্টেশনের সামনে মেট্রোর স্টেশন নির্মিত হবে। এতে কমলাপুর স্টেশন আড়ালে পড়বে। গত ২৪ নভেম্বর রেল ভবনে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ যুক্তিতেই কমলাপুর স্টেশন ভেঙে ১৩০ মিটার উত্তরে শাহজাহানপুরের দিকে স্থানান্তরের প্রস্তাব আসে। রেলমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেলে মেট্রোরেলের লাইন বৃদ্ধির কারণে কমলাপুর স্টেশন স্থানান্তর করা হবে।
রেলওয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান বলেছেন, মেট্রোরেলের কাজ শেষে কমলাপুর স্টেশন স্থানান্তর করা হবে। বর্তমানের স্টেশনের নকশায় হুবহু আরেকটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। গতকাল শনিবার যোগাযোগ করা হলে ব্যস্ত রয়েছেন জানিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন রেলের বর্তমান পরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার।
স্টেশন ভেঙে স্থানান্তরের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভায় বলা হয়েছে, মেট্রোরেলের এলিভেটেড কাঠামোর জন্য কমলাপুর স্টেশন যেন ঢেকে না যায় সে জন্য মূল অংশ (স্টেশন প্লাজা) উত্তর দিকে স্থানান্তর করা যেতে পারে। সিজর ক্রসিংয়ের জন্য স্টেশন স্থানান্তর করা হবে।
কিন্তু গত বৃহস্পতিবার ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিককে পাশে নিয়ে মেট্রোরেলের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (পূর্ত) আবদুল বাকী মিয়া বলেছেন, কমলাপুর স্টেশনের মূল ভবন থেকে ৩০ মিটার দূরে মেট্রোরেলের স্টেশন নির্মাণ হবে। কমলাপুর স্টেশনের উচ্চতা ১৮ মিটার। মেট্রোরেলের স্টেশনের উচ্চতা ২২ মিটার। তাই মেট্রোরেলের স্টেশনের কারণে কমলাপুর স্টেশন আড়ালে পড়ার কারণ নেই। শুধু কমলাপুর স্টেশন নয়, সামনের পার্কিং এলাকাতেও মেট্রোরেলের প্রভাব পড়বে না। কমলাপুর স্টেশন ভাঙার বিষয়টি রেলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
এ বিষয়ে এমএএন ছিদ্দিকের বক্তব্য জানা যায়নি। তবে আবদুল বাকী মিয়া গতকাল সমকালকে বলেছেন, তারা এখনও মনে করেন মেট্রোরেলের কারণে কমলাপুর স্টেশন ভাঙার প্রয়োজন নেই। জাতীয় সংসদের মতো স্থাপনার পাশ দিয়ে মেট্রোরেল যাচ্ছে। এর জন্য সংসদ ভাঙার প্রয়োজন পড়েনি। বর্ধমান হাউস থেকে (বাংলা একাডেমি) মাত্র ২০-২৫ মিটার দূর দিয়ে মেট্রোরেল যাচ্ছে। এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাও ভাঙার দরকার পড়েনি। ভবনটি আড়ালেও পড়েনি। কমলাপুর স্টেশন থেকে সেই তুলনায় আরও দূরে মেট্রোরেল লাইন ও স্টেশন হবে।
২০১৬ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়া ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল পথ দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার নির্দেশে তা কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হচ্ছে। জাপানের ঋণে রাজধানীতে আরও চারটি মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে পাতালপথে একটি মেট্রোরেল এসে কমলাপুরে মিশবে।
ঢাকার পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কমলাপুর স্টেশন ভাঙার চিন্তা থেকে সরে আসতে এরই মধ্যে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের নানা ইতিহাস জড়িয়ে থাকা স্টেশনটি রক্ষার দাবি উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
কমলাপুরের আগে দেশের প্রধান স্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়ায়। ঢাকার উত্তর-দক্ষিণের যোগাযোগে বাধা ছিল ১৮৮৫ সালে নির্মিত ছোট্ট ওই স্টেশনটি। ১৯৫৮ সালে স্টেশনটি কমলাপুরে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দুই মার্কিন স্থপতি ড্যানিয়েল বার্নহ্যাম এবং বব বুই সিডনির বিখ্যাত অপেরা হাউস এবং গ্রাম-বাংলার কুঁড়েঘরের মিশেলে কমলাপুর স্টেশনের নকশা করেন। ১০ বছর পর ১৯৬৮ সালে চালু হয় কমলাপুর স্টেশন। শুধু ছাদ আর চারদিকে খোলামেলা- এ সাদাসিধে নকশাই কমলাপুরকে অনন্য করে তোলে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামছুল হক বলেছেন, পরিকল্পিত উন্নয়ন হলে এ অবস্থা হতো না। উন্নয়ন মানে ঐতিহ্য ভাঙা নয়। হুবহু আরেকটি ভবন নির্মাণ করলেই কমলাপুর স্টেশনের মতো ঐতিহ্যবাহী, স্মৃতিবিজড়িত হবে না। স্টেশন ভবনকে রক্ষা করে উন্নয়নের পথ খোঁজা উচিত।
ডিএমটিসিএলের সাবেক পরিচালক শামছুল হক বলেন, মেট্রোরেল সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল পর্যন্ত নেওয়ার প্রস্তাব ছিল। সায়েদাবাদে বিপুল জায়গা খালি। ওই পর্যন্ত মেট্রোরেল গেলে ঢাকায় আসা যাত্রীরা সেখান থেকে অনায়াসে মেট্রোরেলে শহরের অভ্যন্তরে আসতে পারতেন। কিন্তু সেই সুযোগ নষ্ট করা হয়েছে গুলিস্তান থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণ করে। এ কারণেই এখন মেট্রোরেলের সঙ্গে কমলাপুর স্টেশনের ঠেলাঠেলি সৃষ্টি হয়েছে।