৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১০:৪২

সিলেট-ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ যেন মরণ ফাঁদ

সিলেট-ঢাকা রেলপথে ৩টি এবং সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে ২টি নতুন ট্রেন চালু হলেও এই রেলপথগুলো সংস্কার না হওয়ায় দুর্ঘটনা পিছু ছাড়ছে না এই রুটের যাত্রী সাধারণের। সংস্কারবিহীন রেলপথ, চরম ঝুঁকিপূর্ণ রেলওয়ে ব্রিজ থাকায় এক আতঙ্কের নাম। অহরহ ট্রেন দুর্ঘটনায় রেলপথ পরিণত হয়েছে মরণ ফাঁদে। একের পর এক দুর্ঘটনার কারণে সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে ট্রেনে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁওয়ের বিয়ালীবাজারে তেলবাহী ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। লাইনচ্যুত হওয়া বগি গুলোর মধ্যে ৫টি ডিজেলবাহী বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় কোটি টাকার লোকসান হয়। প্রায় ২৮ ঘন্টা পর গত শুক্রবার গভীর রাতে সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রামের সাথে রেল যোগাযোগ চালু হয়।

জানা যায়, বগিগুলোতে সিলেটের যমুনা অয়েল কোম্পানী ও পদ্মা অয়েল কোম্পানীর ২লাখ লিটার ডিজেল ছিলো। সেই হিসেবে প্রতিটি লিটার ডিজেল ৬৫ টাকা করে হলে প্রায় ২লাখ লিটার ডিজেলের দাম পড়ে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর পযর্ন্ত স্থানীয়রা জলাশয়, পুকুর ও কৃষি জমি থেকে বালতিসহ বিভিন্ন ধরণের পাত্র ভরে ডিজেল সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। পুরুষ ও শিশুদের পাশাপাশি গৃহবধূরাও তেল সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। দুর্ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থলের আশপাশের অনেক পুকুর-জলাশয়ে এ থেকে জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকান্ডসহ বড় ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও দমকল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকায় কোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দুর্ঘটনায় রেলপথের প্রায় ৮০০ মিটার রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। এরআগেও একাধিকবার তেলের বগি লাইনচ্যুত হলেও স্থায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি এসব দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন হয়নি।

তেলবাহী ট্রেনের ১০টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় বগিগুলো পড়ে গেলে তেল রেল লাইনের আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এ তেল সংগ্রহে ভিড় করছে মানুষ। কেউ বালতি করে কেউ গ্লাস নিয়ে তেল সংগ্রহ করেন। দুর্ঘটনার পর পরই তেল সংগ্রহে হুমড়ি খেয়ে পড়েন স্থানীয়রা। তারা তেল সংগ্রহের জন্য বালতি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতেও দেখা যায়। অনেককে দেখা গেছে, ট্রেনের মধ্যে থেকেও তেল নিতে। এসময় কিছু লোককে তেল কিনতে দেখা যায়। তারা লোকজনের কাছ থেকে ২০-৩০ টাকা লিটার দরে তেল সংগ্রহ করে ড্রামে ভর্তি করে মজুদ করছে।

সিলেটের যমুনা ডিপোর ব্যবস্থাপক (বিক্রয় বিভাগ) আব্দুল বাকী বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে তেলবাহী বগি লাইচ্যুত হওয়ায় সিলেটের পদ্মা ও যমুনার প্রায় ২লাখ লিটার তেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ডিজেল ভর্তি ২টি বগি ছিলো যমুনার ও ৩টি বগি ছিলো পদ্মার। ট্রেনে করে তেলগুলো ডিপোতে পৌঁছার পর পরিমাপ করে টাকা নির্ধারণ করা হয়।

কত টাকার ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় যে ক্ষতি হয়েছে তা আমাদের নয়। ডিপোতে তেল পৌঁছার পর যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটত তাহলে সেই ক্ষতি আমাদের হত।

সূত্র জানায়, লাইনচ্যুত হওয়া তেলের ১০টি বগির মধ্যে ৫টি বগি ছিলো সিলেটের যমুনা অয়েল কোম্পানী ও পদ্মা অয়েল কোম্পানীর। এরমধ্যে ২টি যমুনা কোম্পীর ও ৩টি পদ্মা কোম্পানীর। তেলবাহী প্রতিটি বগিতে প্রায় ৪০ হাজার লিটার ডিজেল ধারণক্ষমতা রয়েছে। ৫টি বগি থেকে প্রায় ২লাখ লিটার ডিজেল পড়ে যায়। তেলগুলো চট্টগাম থেকে সিলেটে আসার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এরআগে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর রবিবার দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী একটি তেলবাহী ট্রেন শাহজিবাজার স্টেশনে প্রবেশের সময় ৫টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এসময় ট্রেনের বগিতে আগুন ধরে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
অপরদিকে, ২০২০ সালের ৭ নবেম্বর শনিবার শ্রীমঙ্গলে তেলবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হলে তেল হরিলুট হয়। শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও এলাকায় সিলেটগামী একটি মালবাহী ট্রেনের তেলবাহী ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এসময় স্থানীয় লোকজন পড়ে যাওয়া বগিগুলো থেকে তেল নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ঘটনার পর পর পুলিশ বার বার চেষ্টা করেও জনগণকে রুখতে পারেনি। এসময় মেঘনা পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেডের প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার লিটার তেল পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এছাড়া ঢাকা-সিলেট রেলপথের আখাউড়া-সিলেট অংশে এক বা একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে, এর বেশির ভাগই লাইনচ্যুতির ঘটনা। এর মধ্যে ২০১৯ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১০টি। ওই বছরের ১৬ মে ফেঞ্চুগঞ্জে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন, ২ জুন শায়েস্তাগঞ্জে কুশিয়ারা এক্সপ্রেস, ২০ জুলাই একই স্থানে কালনী এক্সপ্রেস, ১৯ জুলাই কুলাউড়ায় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, ৪ সেপ্টেম্বর ও ১৬ আগস্ট একই এলাকায় উপবন এক্সপ্রেস, ১৭ সেপ্টেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জে জালালাবাদ এক্সপ্রেস, ৪ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জালালাবাদ এক্সপ্রেস, ২৯ ডিসেম্বর কুলাউড়ার বরমচালে একটি মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এছাড়া মুখোমুখি সংঘর্ষ ও সেতু ভেঙে বগি পানিতে পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও রয়েছে।

২০১৯ সালে এ রেলপথে দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২১ যাত্রী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল নবেম্বরে। ওই ঘটনায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়। আহতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে যায়। দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যায় ট্রেন দুটির বগি-ইঞ্জিন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেলপথ। এর আগে ২০১৯ সালের ২৩ জুন, অর্থাৎ কসবার দুর্ঘটনার পাঁচ মাস আগে সেতু ভেঙে লাইনচ্যুত হয়ে পানিতে পড়ে যায় উপবন এক্সপ্রেসের একটি বগি। চারজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ওই দুর্ঘটনায় আহত হন অন্তত ৬৪ যাত্রী।

সর্বশেষ ২০২১ সালে ৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাওয়ে তেলবাহি একটি ট্রেনের ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে।
এই রেলপথে যাওয়া আসাকারী যাত্রী সাধারণ ও বিশিষ্টজনরা দ্রুত গতিতে ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ ও স্লিপারগুলো পরিবর্তন করে নতুন আঙ্গিকে সংস্কারের জোর দাবি জানান।

https://dailysangram.com/post/442993