৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১০:৩৯

করোনাকালে মানুষ খাবার খরচ কমিয়েছে ৩০ ভাগ ॥ অন্য পণ্যে ৬৩ শতাংশ

গত মাসে প্রকাশিত সানেমের প্রতিবেদন বলছে, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশে দারিদ্যের হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে দারিদ্যের হার ৪২ শতাংশ। ২০১৮ সালে যা ছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের বর্তমান দারিদ্র্যের হার আবার শহরের থেকে গ্রামীণ অঞ্চলে বেশি প্রকট। শহর অঞ্চলে এই হার ৩৫ শতাংশ হলেও গ্রাম অঞ্চলে এই হার ৪৫ শতাংশ। করোনার সময়ে এই দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। কারণ মানুষ এই সময় আয় করতে পারেনি। ৫৬ ভাগ পরিবারের আয় কমে গেছে। বিবিএসের খানা জরিপ অনুসারে ২০১৬ সালে গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬.৪ শতাংশ, ২০১৮ সালের জিইডি সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪.৫ শতাংশ, করোনাকালীন ২০২০ সালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪৫.৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮.৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ১৬.৩ শতাংশ আর করোনাকালীন ২০২০ সালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৩৫.৪ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৪.৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ১১.২ শতাংশ এবং মহামারীর সময়ে ২০২০ সালে গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৩৩.২ শতাংশ। শহরাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ৭.৬ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৬.১ শতাংশ কিন্তু ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ১৯ শতাংশ। ২০২০ সালে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বরিশালে ছিল ২৯.৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৩৫.১ শতাংশ, ঢাকায় ৩৮.৪ শতাংশ, খুলনায় ৪১.৮ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৪৬.২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৫৫.৫ শতাংশ, রংপুরে ৫৭.৩ শতাংশ এবং সিলেটে ৩৫ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীতে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হওয়ার যে তথ্য সানেম দিয়েছে তা বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত। তারা যদি মেহেরবানি করে বলতে পারেন যে, কয়টা গ্রামে গিয়েছেন, কয়টা মানুষের সঙ্গে দেখা করেছেন...পুরোটাই অযৌক্তিক, রিয়েল পজিশন থেকে ডেসটর্টেড। না খেয়ে একজনও নেই। আপনারা যদি বলতে পারেন যে কেউ না খেয়ে আছে সেটা আমরা দেখব।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে বলে সানেম যে তথ্য দিয়েছে, তা কোনোভাবেই সঠিক নয়। তাদের পুনরায় ভালো করে খোঁজ নেওয়ার দরকার আছে। আমরা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি ‘ধারণা জরিপ’ করেছি। তাতে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে। তাই সানেমের তথ্য মেনে নিতে পারছি না।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারীর ফলে কাজ হারানো, পারিশ্রমিক না পাওয়া, কর্মক্ষেত্র বন্ধ হওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থান-সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কেবল ১৭.৩% পরিবারের দাবি ছিল যে তাদের সদস্যরা আগের মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে পেরেছে। ৫৫.৯% পরিবার দাবি করেছেন যে কাজ থাকা সত্ত্বেও তাদের আয় হ্রাস পেয়েছে, ৮.৬% দাবি করেছে যে তারা কাজ হারিয়েছে, ৭% এর কাজের সময় হ্রাস পেয়েছে এবং ৩৩.২% বলেছে যে তাদের কাজ শুরু হওয়ার পরে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থেকে আবার শুরু হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে, সব ধরনের কর্মসংস্থানে গড় আয় হ্রাস পেয়েছে, যা স্ব-নিযুক্তদের জন্য ৩২%, বেতনভিত্তিক কর্মীদের জন্য ২৩%, দিনমজুরের জন্য ২৯% এবং অন্যদের জন্য ৩৫%।

সঙ্কটের মোকাবেলার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বল করেছে। ৪৮.৭২% ঋণ নিয়েছে, ৩২.৪% সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরশীল, ২৭.৩৩% খাদ্য-ব্যয় কমিয়েছে, ২৭.০২% তাদের খাদ্যতালিকায় অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে এবং ১৬.৬৭% বন্ধু / আত্মীয়ের কাছ থেকে অনুদান নিয়েছেন। গবেষণায় রেমিট্যান্স আয়ের একটি বৈপরীত্যও তুলে ধরা হয়েছে। ম্যাক্রো-স্তরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেলেও, পারিবারিক পর্যায়ে অভিবাসী সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ৮২.০৫% পরিবার দাবি করেছেন যে তারা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স কম পেয়েছেন এবং দেশের অভ্যন্তরের মাইগ্রেশনের ক্ষেত্রে ৬৪% দাবি করেছেন যে তারা মহামারীর আগে যা পাচ্ছিলেন তার তুলনায় কম পেয়েছেন। এই প্যারাডক্সের একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো মহামারীর আগে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স আসছিল। যেহেতু এই চ্যানেলগুলো অবরুদ্ধ করা হয়েছে, তাই পরিবারগুলো আগের তুলনায় কম অর্থ পেয়েছে।

এ বিষয়ে ড. এম এম আকাশ বলেন, কোভিডের কারণে যে ক্ষতি হলো এটি কি স্বল্পমেয়াদি, নাকি এত বছরের অগ্রগতির ওপরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ল, সেটি ব্যাখ্যার বিষয়। এটি নির্ভর করবে ক্ষতির ধরন কেমন, কোন খাত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সরকার যে জরুরি পদক্ষেপ নিলো তা কতটুকু পর্যাপ্ত তার ওপর। আয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে (আল্টা রিচ) যারা আছেন তাদের বিষয়েও গবেষণা হওয়া দরকার যা দেশব্যাপী জরিপে সাধারণত উঠে আসে না।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে দারিদ্র্যের ওপর প্রভাব পড়ছে এবং কোভিড-১৯ এর পূর্বের দারিদ্র্য বিষয়ক অর্জনগুলো কোভিড-১৯ এর প্রভাবে উল্টে যাবে, সেই ধারণাটি আরো জোরালো হয়েছে সানেমের সমীক্ষার মাধ্যমে। স্বাভাবিক সময়েও আয় বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য ও ভোগ বৈষম্য বজায় ছিল, অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল অসম। এই কঠিন সময়ে টিকে থাকার লড়াইতে দরিদ্রদের জন্য যথেষ্ট উপায় নেই, আর যারা সচ্ছল তাদের ওপর অত প্রভাব পড়ে না। কাজেই এই অসাম্য থেকে হয়তো আমরা খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি পাবো না। কোভিডের কারণে বৈষম্য যে আরো ঘণীভূত হলো, তা মোকাবেলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে সামাজিক ও মানবিক মূলধনের ওপর খেয়াল রাখতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই সার্ভেতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে তা হলো, দারিদ্র্যের ভৌগোলিক আওতা ছড়িয়ে পড়েছে, গ্রামেও যে হারে দারিদ্র্য বেড়েছে শহরেও সেই একই হারে বেড়েছে। আবার যেখানে আগে দারিদ্র্য কম ছিল সেখানেও ব্যাপক বেড়েছে, যেখানে বেশি ছিল সেখানেও ব্যাপক বেড়েছে। রেমিট্যান্স বেড়ে গেছে বলা হলেও, প্রকৃত রেমিট্যান্স কিন্তু কমে গেছে। যা বেড়েছে তা হলো ফরমাল রেমিট্যান্স।

https://dailysangram.com/post/443034