৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:১৮

বোটানিক্যাল গার্ডেনে দর্শনার্থীরা আতঙ্কে

কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বাড়ছে অপরাধ

তখন দুপুর ২টা। ১৪-১৫ বছরের তিন কিশোর বোটানিক্যাল গার্ডেনের মাধবী রেস্ট কর্নারের নির্জন পথের পাশে একে অপরের দিকে চাকু নাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। এ প্রতিবেদককে দেখে মুহূর্তে চাকুগুলো পকেটে ঢুকিয়ে স্থান পরিবর্তন করে চলে যায় দোলনচাঁপা শিশু উদ্যানসংলগ্ন ঝোপে। সেখানে বসে তিন কিশোর ধূমপান করে। পরে সেখান থেকে সটকে পড়ে বাঁশ বাগান এলাকায়। প্রায় আধাঘণ্টা পর ওই তিন কিশোর শাপলা পুকুরের রাস্তা ধরে মূল গেটের দিকে যেতে থাকে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রবেশ টিকিটে দেওয়া আছে মোবাইল ফোনের ০১৯০৪৩০৫২৯৪ এই নম্বরটি। দ্রুত ফোন করে কর্তৃপক্ষকে ওই তিন কিশোরের গতিবিধি জানালে তাৎক্ষণিক নিরাপত্তাকর্মী, ইজারাদারসহ আরো কয়েকজন এসে ওই তিন কিশোরকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি সুইচ গিয়ার চাকু। ইজারাদার অনুমান করেন, অন্য দুটি চাকু তারা ভেতরে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। এই তিন কিশোরের চুলের কাটিং ও রং, গলায় পরা চেইন দেখে সহজে বোঝা যায় এরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। সুযোগ খুঁজছিল চাকু ঠেকিয়ে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা কিংবা মালামাল হাতিয়ে নেওয়ার।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মিরপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেন (জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান) ঘুরে এই চিত্র দেখা গেল। চাকুসহ হাতেনাতে তিন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে আটক করে কর্তৃপক্ষ। এর আগে গত বুধবার সকালে বোটানিক্যাল গার্ডেনের জালিয়াভাঙা লেকপারে এক নারীর হাত থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় এক ছিনতাইকারী।

এভাবেই বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইকারী, ইভ টিজার, ফিটিংবাজ কিংবা কিশোর গ্যাংচক্রের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন। এতে দর্শনার্থীরা আনন্দের পরিবর্তে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ছেড়ে আসেন গার্ডেন এলাকা। দর্শনার্থীদের অভিযোগ, ২০৮ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা বোটানিক্যাল গার্ডেনে এই দুষ্টচক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে না পারার পেছনে রয়েছে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। ফলে আতঙ্ক নিয়েই দর্শনার্থীদের যেতে হয় এই উদ্যানে।

এক হাজার প্রজাতির ৬৮ হাজার গাছের এই গার্ডেনে বিভিন্ন অপরাধীচক্র গড়ে ওঠায় ধীরে ধীরে কমছে দর্শনার্থীর সংখ্যা। আর অনেকে এই গার্ডেনে একা যেতে ভয় পান। যাঁরা আসেন, তাঁদের অনেকে দল বেঁধে আসেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে যাঁরা আসেন তাঁরা নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্যানের বেশি ভেতরে যান না। লেকপার আর শিশু উদ্যানে চলাচল সীমাবদ্ধ রাখেন।

রত্না ও উজ্জ্বল নামে এক জুটি জানান, দুই-তিন বছর ধরে এই উদ্যানে আসছেন তাঁরা। তবে সব সময় মনে কেমন একটা আতঙ্ক কাজ করে। প্রায়ই চকোলেট-বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে দাম নেওয়ার সময় রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল করা হয়। হাতিরঝিলে ছিনতাইকারীদের পুলিশ আটক করছে। এই উদ্যানেও ছিনতাইকারীরা নানা বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুযোগ পেলেই দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা কিংবা মালামাল ছিনিয়ে নিচ্ছে। এদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে দর্শনার্থীদের জন্য গার্ডেনটি নিরাপদ করা হোক।

গোলাপবাগ থেকে আসা দর্শনার্থী জাহিদ রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্রামের বাড়ি থেকে স্বজনরা এসেছে। তাদের আবদার মেটাতে চিড়িয়াখানা এবং বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখাতে নিয়ে এসেছি। তবে এখানে প্রেমিক যুগলের কর্মকাণ্ডে অবাক হচ্ছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে আসা রীতিমতো বিব্রতকর।’

গার্ডেন ঘুরে বেরিয়ে আসার পথে আটক করা তিন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে ইজারাদার মেসার্স ফেমার্স ডিজাইন লিমিটেডের একজন সদস্য জানান, তাদের পুলিশে দিলে নানা ধরনের ঝামেলা তৈরি হবে। এ কারণে তাদের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওই কিশোররা গার্ডেনসংলগ্ন এলাকায় থাকে বলে জানান তিনি।

করোনার আগে বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রতিদিন কয়েক হাজার টিকিট বিক্রি হলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে দুই হাজারের নিচে। এ তথ্য জানান ইজারাদার মো. ইউসুফ।

শাহআলী থানার ওসি আবুল বাশার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বোটানিক্যাল গার্ডেনে সাংবাদিক ও পুলিশ পরিচয়ে চাঁদাবাজির দায়ে গত ১৪ জানুয়ারি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়েছে। চক্রের অন্য ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/02/06/1002233