৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:০৮

বাজারে নৈরাজ্য

এক বছরে কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ১০-১৪ টাকা তেল নাগালের বাইরে, বাড়ছে পেঁয়াজের ঝাঁজ

পণ্য বাজারে চলছে নৈরাজ্য। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালে ১০ থেকে ১৪ টাকা দাম বেড়েছে। ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা চালে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দাম বেড়েছে। চালের এই অস্বাভাবিক দামের জবাব নেই খোদ বিক্রেতাদের কাছেও। বিক্রেতারা বলেছেন, যা-ই হোক এত টাকা দাম বাড়তে পারে না। এর পেছনে কোনো কারসাজি আছে। চাল আমদানি করেও চালের বাজারের লাগামহীন ঘোড়ার রশি টানা যাচ্ছে না। এ দিকে চালের এই অস্বাভাবিক মূল্যে ক্রেতারা দিশেহারা। কয়েক টাকা কম মূল্যে চাল কেনার জন্য যে কারণে ওএমএসের দোকানগুলোতে ভিড় জমছে ক্রেতাদের।

এক বছর আগে চালের দাম কত ছিল এবং বর্তমানে কত দামে বিক্রি হচ্ছে তার একটি তুলনামূলক চিত্র গতকাল পাওয়া যায় পাইকারি চাল বিক্রেতাদের কাছ থেকে। ২০২০ সালের এই দিনে মিনিকেট ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ২৫০ থেকে দুই হাজার ৩৫০ টাকা। গতকাল শুক্রবার সেই চাল বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৯০০ থেকে তিন হাজার ২০ টাকায়। আটাশ চাল ২০২০ সালে বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৬৫০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকায়। গতকাল সেই চালের বস্তা বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৩৫০ থেকে দুই হাজার ৪৫০ টাকায়। ২০২০ সালে আতব মোটা চাল বিক্রি হয়েছে বস্তা এক হাজার ৩০০ টাকা। গতকাল সেই চাল বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৯৫০ থেকে দুই হাজার ১০০ টাকা। ২০২০ সালে স্বর্ণা বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা বস্তা, গুঁটি এক হাজার ৩৫০, হাস্কি এক হাজার ৬০০, নাজিরশাইল দুই হাজার ৩৫০ থেকে দুই হাজার ৪০০, চিনিগুঁড়া চার হাজার ৫০০ আর বাশমতি বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৬০০ টাকায়। গতকাল স্বর্ণা চালের বস্তা বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ২২০ টাকা, গুঁটি দুই হাজার ১০০ টাকা, হাস্কি দুই হাজার ৪০০ টাকা, নাজিরশাইল তিন হাজার ১০০ থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা, বাশমতি তিন হাজার ২৫০ টাকা, আর চিনিগুঁড়া বিক্রি হয়েছে তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার ৭০০ টাকায় ৫০ কেজির বস্তা। পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে বস্তা প্রতি আরো ২০০-৩০০ টাকা বেশি। আর অলিগলির দোকানে আরো বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। মানিকনগরের বিভিন্ন দোকান ঘুরে গতকাল দেখা গেছে পাইজাম চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি। আটাশ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজি। ওই সব দোকানে যে যেভাবে পারছেন দাম রাখছেন। ছিদ্দিকুর রহমান নামের এক ক্রেতা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, দোকানিরা যেন পাল্লা দিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন। কে কত রাখছে, কে বেশি রাখছে; আর কে কম রাখছেন ক্রেতারা সেই হিসাবও রাখতে পারছেন না।

টঙ্গীবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো: শাহ আলম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, চালের এই অস্বাভাবিক মূল্যের কারণ তাদের কাছেও অজানা। অতীতে এমন কোনো দিন হয়নি। সরকার চেষ্টা করেও চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। চাল আমদানি হচ্ছে। কিন্তু তার পরও দাম কমছে না। তিনি বলেন, ভারত থেকে যে চাল এসেছে সেসব চালের বস্তা প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কম আছে দেশী চালের চেয়ে। শাহ আলম বলেন, ভারত থেকে যে দিন চাল এ দেশে এসেছে ঠিক সেই দিনই মিল মালিকরা কেজিতে দেশী চাল ৩ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এটিকে কারসাজি মনে করছেন চাল ব্যবসায়ী সমিতির নেতা শাহ আলম। তিনি বলেন, মিল মালিকরা বলছেন ধানের দাম বেশি, তাই চালের দামও বেশি। ধানের দাম বেশি হলেও চালের দাম অত বেশি হওয়ার কথা নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

নাটোরের মিল মালিক মহিদুল ইসলাম খান নয়া দিগন্তকে বলেন, চালের মূল্য বাড়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে ধানের দাম বেড়েছে। গত বছর এই দিনে চিকন ধানের মণ ছিল ১১ শ’ টাকা। অথচ এবার সেই ধান কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৫২০ টাকায়। মোটা ধান ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। সেই ধান কিনতে হচ্ছে এক হাজার ১৫০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়। তিনি বলেন, বাড়তি দাম দিয়েও ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এক গাড়ি ধানের জন্য দু-তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়। মহিদুল ইসলাম বলেন, ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। না হলে তো মূল্য বৃদ্ধির অন্য কোনো কারণ নেই।

এ দিকে চালের এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মানুষ। সেকান্দার শিকদার নামের এক ক্রেতা গতকাল জানান, করোনার কারণে তার বেতন কমেছে শতকরা ৩০ ভাগ। এ সামান্য বেতনে এমনিতেই সংসার চালাতে দিশেহারা। এত দিন ভাবনা ছিল সবজি আর পেঁয়াজ, আলু নিয়ে। এখন চাল নিয়ে। ওএমএস শপে গিয়ে লাইন দেবেন তাও পারছেন না। খাওয়া কমাবেন তাও পারছেন না।

এ দিকে ওএমএস দোকানগুলোতে ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। গত বৃহস্পতিবার মানিকনগরের একটি ওএমএস দোকানে দেখা যায় দোকান খোলার আগেই কম হলেও এক শ’ নারী লাইন দিয়ে আছেন। ওই দোকানে দিনভর লাইন লক্ষ করা যায়।

বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনসাস কনজুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমরা সব সময় বলি চাল উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তা হলে তো দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই।’ পলাশ বলেন, কৃষকের উৎপাদন ব্যয় তেমন বাড়েনি। সরবরাহ খরচা তেমন বাড়েনি। কাজেই চালের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, সরকারের যে অথরিটি বাজার দেখার জন্য রয়েছে হয়তো তারা গুদামজাতকারীদের কাছে জিম্মি না হলে বিক্রি হয়ে গেছে; যে কারণে বাজারের এ অবস্থা। তারা যদি ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করেন, তবে পরিস্থিতি এত খারাপ হওয়ার কথা নয়।

জাগো নিউজ জানায়, এ দিকে হঠাৎ করেই রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো যেন গরম হয়ে উঠেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে আলু, পেঁয়াজ, ডিম, মুরগিসহ প্রায় সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরাপর্যায়ে কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ৩০ টাকায় বিক্রি হওয়া দেশী পেঁয়াজ এক লাফে উঠেছে ৪০ টাকায়। পাইকারিতেও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা।

পেঁয়াজের দামের বিষয়ে কাওরানবাজারের ব্যবসায়ী সফর আলী বলেন, এখন ঢাকার বাজারে দেশী যে পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে তার বড় অংশ আসছে ফরিদপুর থেকে। হঠাৎ করেই ফরিদপুরে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। আর বাড়তি দামে কিনে আনার কারণে আমরাও বাড়তি দামে বিক্রি করছি। তিনি আরো বলেন, গত সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম যে হারে কমেছিল তাতে আমরা ধারণা করছিলাম সামনে আরো কমবে। কিন্তু উল্টো বেড়েছে। গত সপ্তাহে এক পাল্লা পেঁয়াজ ১২৫ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন তা ১৭৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে আমাদের ধারণা পেঁয়াজের দাম আবার কমে যাবে।

খিলগাঁওয়ের ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান বলেন, দুই দিন ধরে পেঁয়াজের দাম বাড়তি। গত বুধবার আড়তে গিয়ে দেখি কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে গেছে। এখন যে দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে তাতে ৪০ টাকার নিচে বিক্রি করার সুযোগ নেই। আগে কম দামে কিনতে পারায় ৩০ টাকায় বিক্রি করেছি। তিনি আরো বলেন, এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম, তাই দাম বাড়ার কথা না। বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহের ঘাটতিও নেই। আড়তে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ রয়েছে। এরপরও কী কারণে দাম বাড়ল বুঝতে পারছি না।
এ দিকে পেঁয়াজের পাশাপাশি দাম বেড়েছে নতুন আলুর। খুচরা বাজারে এক কেজি নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে ১৮ টাকায়। কয়েক দফা কমে যা দুই দিন আগে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। আলুর দাম বৃদ্ধির বিষয়ে মালিবাগ হাজীপাড়ার ব্যবসায়ী মো: জাহাঙ্গীর বলেন, ‘নতুন আলু দুই দিন আগেও ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছি। কিন্তু বৃহস্পতিবার শ্যামবাজারে গিয়ে দেখি আলুর দাম কেজিতে তিন টাকা বেড়ে গেছে। সে কারণে এখন আমরা ১৮ টাকা কেজি বিক্রি করছি। এই ব্যবসায়ী বলেন, আলু এখনো হিমাগারে যাওয়া শুরু হয়নি। বাজারে আলুর সরবরাহেরও কোনো সমস্যা নেই। আড়তে প্রচুর বড় আলু। এরপরও দাম বেড়েছে। আমাদের ধারণা, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণে আলুরও দাম বেড়েছে।

আলু ও পেঁয়াজের পাশাপাশি দাম বেড়েছে বয়লার মুরগি ও ডিমের। গত সপ্তাহে ৮৫ টাকা ডজন বিক্রি হওয়া ডিমের দাম বেড়ে এক লাফে ১০০ টাকা হয়েছে। আর ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে ১৪০ টাকা হয়েছে।

রামপুরার মুরগি ব্যবসায়ী শরিফুল বলেন, মাঝে ব্রয়লার মুরগির চাহিদা কমে গিয়েছিল। যে কারণে দাম কমে ১১৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। তবে কিছু দিন ধরে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে। গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১২০ টাকা বিক্রি করেছি এখন ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ব্রয়লার মুরগির দাম পাইকারি বাজারের ওপর নির্ভর করে। পাইকারিতে দাম বাড়লে আমরা দাম বাড়াতে বাধ্য হই। কয়েক দিন ধরে পাইকারি বাজারের যে চিত্র দেখছি তাতে সহসা দাম কমার সম্ভাবনা কম।

ডিমের দামের বিষয়ে মালিবাগ হাজীপাড়ার ব্যবসায়ী মো: সাবু বলেন, গত সপ্তাহে এক ডজন ডিম ৮৫ টাকায় বিক্রি করেছি। পাইকারিতে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন ১০০ টাকা ডজন বিক্রি করছি। পাইকারিতে দাম কমলে আবার কম দামে বিক্রি করব।

এ দিকে শীতের সবজির পর্যাপ্ত সরবরাহে সবজির দামে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের সবজির দাম বেড়ে গেছে। গত সপ্তাহে ১০ থেকে ২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পাকা টমেটোর দাম বেড়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৫০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৫ থেকে ৩০ টাকা। মুলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা। ১০ থেকে ২৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া বেগুনের দাম বেড়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা হয়েছে।

হঠাৎ সবজির দাম বাড়লেও গাজর, ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। গত সপ্তাহের মতো গাজরের কেজি ১৫ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপির পিস বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। তবে লাউয়ের দাম কিছুটা বেড়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪০ টাকার মধ্যে।

কাওরানবাজারের ব্যবসায়ী হালিম শেখ বলেন, ‘শিমের সরবরাহ আস্তে আস্তে কমে আসছে। এ কারণে এখন একটু দাম বাড়তি। তবে টমেটো ও গাজরের সরবরাহ বাড়ছে। এ কারণে সবজির দাম এখনো তুলনামূলক কম। কিছুদিন পর সবধরনের সবজির দাম বেড়ে যাবে বলে আমরা ধারণা করছি।

খিলগাঁওয়ের ব্যবসায়ী মো: মিলন বলেন, সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কিছুটা বাড়লেও সবজির এখন যে দাম তাকে বাড়তি বলা যায় না। আমাদের ধারণা, আরো মাসখানেক সবজির এমন দাম থাকবে। তারপর হয়তো বেশির ভাগ সবজির কেজি ৫০ টাকার ওপরে চলে যাবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/560932