৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:০০

ভয়ঙ্কর মাদক ‘আইস’

ইয়াবার স্রোত সামলাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিমশিম খাওয়ার মধ্যে দেশে মাদকের তালিকায় যোগ হয়েছে ‘আইস’; যা আরও বেশি ক্ষতিকর বলে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য। প্রায় দুই বছর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিয়মিত অভিযানে ৫ গ্রাম আইসসহ এক যুবককে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। তখনই আইসের কথা জানা যায়। আইস বা ক্রিস্টাল মেথে শতভাগ এমফিটামিন থাকায় এটা বিশ্বজুড়েই ভয়ঙ্কর মাদক হিসেবে চিহ্নিত। আইস মানবদেহে অতি অল্প সময়ে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। সেবনে মস্তিষ্কের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই মাদক সেবনের ফলে স্মৃতি শক্তি লোপ পায়।

এদিকে, বাজারে চাহিদার চেয়ে জোগান কম হওয়ায় ক্ষতিকর উপাদান দিয়ে বানানো হচ্ছে নকল ইয়াবা। এতে তাৎক্ষণিক মৃত্যুও ঘটতে পারে সেবনকারীর।
মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, মাদকাসক্তের একটা বড় অংশই ইয়াবায় আসক্ত। জব্দকৃত মাদকের প্রায় অর্ধেকই থাকে ইয়াবা। স্বভাবতই চাহিদার চেয়ে জোগান কম এই মাদকের। যার কারণে বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে ভেজাল বড়ি বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে কারবারিরা। যা সেবনে দেখা দেবে বিষক্রিয়া। তাৎক্ষণিক মৃত্যু হতে পারে মাদকসেবীর।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কেন্দ্রীয় প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ডা. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘আমরা দিনে যতগুলো জব্দকৃত ইয়াবা চালানের নমুনা পরীক্ষা করি, তার মধ্যে ৪-৫টি চালানে নকল বা ভেজাল ইয়াবা পাই। প্রথম পেয়েছিলাম জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল। তবে এখন আরও অনেক কিছুর মিশ্রণে বানানো হচ্ছে নকল ইয়াবা। এগুলো সেবন করলে দেখা যায় মাদকসেবীরা সেভাবে উদ্দীপনা বোধ করে না। তখন তারা একাধিক ইয়াবা সেবন করে। তাতেও বেড়ে যায় তাৎক্ষণিক মৃত্যুর ঝুঁকি।’
এই রাসায়নিক পরীক্ষক আরও বলেন, ‘এসব নকল ইয়াবার একেকটি বড়ি বানাতে ২-৩ টাকার বেশি লাগে না। এ কারণেও মাদক ব্যবসায়ীরা এ পথ বেছে নেয়। এই পিলগুলোকে ইয়াবার রূপ দিতে এমন কিছু রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যাতে বিষক্রিয়া হবেই।’

ইয়াবার চালানে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের রাসায়নিক পরীক্ষাগারের সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় বছর খানেক আগে আমরা একটি চালান পরীক্ষা করি। তাতে ইয়াবা তৈরির একটি প্রধান উপকরণই ছিল না। অবাক হয়েছিলাম আমরা। এখন প্রতিদিনই জব্দকৃত চালানে নকল ইয়াবার স্যাম্পল পাচ্ছি। গত এক বছরে কমপক্ষে এক হাজার ইয়াবার চালানের নমুনায় ভেজাল ইয়াবা পেয়েছি।’

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু যে ঢাকার চালানগুলোতেই ভেজাল থাকে, তা নয়। সারা দেশ থেকে আসা বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাবের জব্দকৃত ইয়াবা চালানের নমুনায়ও ভেজাল মাদক পাচ্ছি।’

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মাদক কারবারিরা গ্রাহকদের হাতে চালান তুলে দেওয়ার সময় ইয়াবার সঙ্গে গর্ভনিরোধক বড়িও মিশিয়ে দিচ্ছে। তাতেও আবার আসক্ত হচ্ছে আরেকটি শ্রেণি। রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ আশপাশের কিছু বস্তিতে এমন মাদকসেবীর সন্ধান পাওয়া গেছে।’

ইয়াবা সেবনে ক্ষতি
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেনটাল হেলথের সাইকোথেরাপির অধ্যাপক মনোবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বলেন, ‘অনেকে ইয়াবা গ্রহণ করে যৌন উদ্দীপক হিসেবে। কিন্তু এটি সেবনে ক্রমান্বয়ে যৌনক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যায়। শুক্রাণু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সন্তান উৎপাদন ক্ষমতাও কমে যায়। মেয়েদের মাসিকেও সমস্যা হয়।’ ‘এছাড়াও, হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, লিভার, কিডনি থেকে শুরু করে শরীরের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। ইয়াবা খেলে রক্তচাপ বাড়ে। লিভার সিরোসিস থেকে লিভার ক্যান্সারও হতে পারে।’

মোহিত কামাল আরও বলেন, ‘ইয়াবা খেলে মস্তিষ্কের সরু রক্তনালী ছিঁড়ে রক্তক্ষরণের ঘটনাও আমরা দেখেছি। ব্রেইন ম্যাটার তথা মগজটাও সংকুচিত হয়ে যায়। সুস্থ মানুষের যদি ১৫০০ গ্রাম থাকে, সেটা শুকিয়ে এক হাজার গ্রামের নিচে নেমে যায় মাদকসেবীর। জেনেটিক মলিকিউলও নষ্ট করে দিতে পারে ইয়াবা। ফলে পরবর্তী প্রজন্মও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, ইয়াবার বড় চালানগুলো মূলত মিয়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে কক্সবাজার ও টেকনাফে প্রবেশ করে। এরপর সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ও বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে পাচার হয়।

নতুন মাথাব্যথা ‘আইস’
প্রায় দুই বছর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিয়মিত অভিযানে ৫ গ্রাম আইসসহ এক যুবককে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তখনই আইসের কথা জানা যায়। এরপর ওই যুবকের স্বীকারোক্তিতে জিগাতলার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় হাসিব বিন মোয়ামের রশিদ নামে এক ব্যক্তিকে।

রশিদ ওই বাসার তলকুঠুরীতে ‘আইস’ তৈরির কারখানা বসিয়ে সবে উৎপাদন শুরু করেছিল বলে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, রশিদের কাছে ২৯ গ্রাম ‘আইস’ পাওয়া গিয়েছিল। পরে রশিদের স্বীকারোক্তিতে বসুন্ধরা এলাকায় থেকে নাইজেরীয় এক নাগরিককে ৫০০ গ্রাম ‘আইস’ সহ গ্রেফতার করা হয়। “ওই কারখানার সন্ধান না পাওয়া গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হত,” বলেন খুরশীদ।

দুই মাদকের তুলনা করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, “ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে পাঁচ ভাগ, আর আইসের পুরোটাই এমফিটামিন। ফলে এটি ইয়াবার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ক্ষতিকর এবং অনেক বেশি পরিমাণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে মানবদেহে।”

অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, “মানবদেহে অতি অল্প সময়ে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে এই মাদক। “এই মাদক সেবনে মস্তিষ্কের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই মাদক সেবনের ফলে স্মৃতি শক্তি লোপ পায়।” আইস বা ক্রিস্টাল মেথে শতভাগ এমফিটামিন থাকায় এটা বিশ্বজুড়েই ভয়ঙ্কর মাদক হিসেবে চিহ্নিত, বলেন তিনি।

গতবছর নভম্বরে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে মেথামফিটামিন মাদক ‘আইস’ বা ‘ক্রিস্টাল মেথ’সহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গতবছর নবেম্বরে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে মেথামফিটামিন মাদক ‘আইস’ বা ‘ক্রিস্টাল মেথ’সহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মো. মোসাদ্দেক হোসেন রেজা বলেন, দুই বছর ধরে আইস দেশে আসতে শুরু করেছে। গত ৪ নভেম্বরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গেণ্ডারিয়া থেকে ছয়জনকে ৬০০ গ্রাম আইসসহ গ্রেফতার করে।

ডিএমপির উপ-কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক বলেন, ঢাকায় পুলিশের অভিযানে আইস পাওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম। এরপর এ বছরের ১৪ জানুয়ারি হাতিরপুল ও হতিরঝিল এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে আইসসহ চারজনকে গ্রেফতার করে।

অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আইস থাইল্যান্ডে বেশি ব্যবহার হয়। এই মাদকটিও মিয়ানমার হয়ে আসতে শুরু করেছে। ইয়াবার সঙ্গে আইসও পাওয়া যাচ্ছে।”

বাংলাদেশে শুরুর দিকে মাদক হিসেবে আফিম ও গাঁজাই চলত। গত শতকের ৮০ এর দশকে সেগুলো নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সময়ে কোডিন মিশ্রিত কফ সিরাপ নিষিদ্ধ হওয়ার পর চোরাই পথে আসা ফেনসিডিল হয়ে ওঠে মাদকসেবীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। প্রায় দুই দশক হল ফেনসিডিলের জায়গা দখল করেছে ইয়াবা। ফেনসিডিল মূলত আসত ভারত থেকে, আর ইয়াবা আসছে মিয়ানমার থেকে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে নানা বৈঠকে ফেনসিডিল পাচার বন্ধে আহ্বান জানানো হয়, যার ফলও পাওয়া যায়। কিন্তু ইয়াবা পাচার বন্ধে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া না পাওয়ার কথা গত বছরও বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। ইয়াবা সহজে বহনযোগ্য বলে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৯ সালে মূলত ইয়াবা ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়েই মাদকের বিরুদ্ধে বড় অভিযানে নেমেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে কয়েকশ জন। বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ওই ঘটনায় র‌্যাব-পুলিশকে ব্যাপক সমালোচনায় পড়তে হলেও সেই অভিযানেও ইয়াবা পাচার বন্ধ হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবা ধরার খবর আসছে।

এরমধ্যে আইসের ব্যবহার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা উদ্বিগ্ন- জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, “এটি খুবই ব্যয়বহুল মাদক। এজন্য ইয়াবার মতো ছড়ানোর আশঙ্কা কম। তবে পুলিশ সতর্ক আছে, যাতে এই মাদকটির বিস্তার ঘটতে না পারে।”
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আইস মালয়েশিয়া হয়েও আসে। সেখানে ১ গ্রাম আইসের দাম ১৫ হাজার রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন লাখ টাকার বেশি।
উপকমিশনার আজিম বলেন, “স্রোতের সঙ্গে সবকিছুই আসবে। আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।”

https://dailysangram.com/post/442946