৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১০:৫৭

দেশ সোনায় ভরতে সোনার মানুষ দরকার

সকলের প্রিয় এ দেশ। এখানকার মাটি, জল, হাওয়া আমরা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। এখানে সোনারঙ ধান উৎপন্ন হয়। সোনালি পাট জন্মে। সোনার দামে বিদেশে তা বিক্রিও হয়। গম উৎপাদন হয়। পাকলে তাও সোনারঙ ধারণ করে। এ দেশের মাটির নিচে সোনার খনি আছে। তবে তা উত্তোলনের জন্য ব্যয়বহুল আধুনিক প্রযুক্তি ও সোনার মানুষ আমাদের নেই।

দেশের নদ-নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলের বেলাভূমিতে অভ্র, জিঙ্ক, সিলিকন প্রভৃতি মূল্যবান খনিজপদার্থ রয়েছে। সোনাসহ এসব পদার্থ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সোনার মানুষ প্রয়োজন সবার আগে। কিন্তু সেই সোনার মানুষ কোথায়? দেশের সবখানে সোনা দিয়ে ঠাসা। কেবল সোনার মানুষের বড় অভাব। সোনার মতো মন খুঁজে পাওয়া মুশকিল এখানে। মানুষ এবং মানুষের মন যদি সোনা না হয়, কী হবে এতোসব সোনা দিয়ে? সোনাধান থেকে প্রাপ্ত চালের ভাতে পেট ভরলেও আসল সোনা রেঁধে খাওয়া যেমন যায় না, তা দিয়ে উদরপূর্তিও ঘটে না।

কেউ যদি পেটভরে খেতে না পায় তাহলে তাকে টন টন সোনা দিলেও নেবে না। খাবার সংস্থান যদি থাকে, মাথাগুঁজোবার ঠাঁই হলে এবং পরনের ব্যবস্থা থাকলে সোনার চাহিদা থাকবে। মৌলিক প্রয়োজন মিটলে না সোনার কথা মনে পড়বে? সোনা দিয়ে অলঙ্কার গড়বার কথা মনে হবে? এর আগে নয়। সোনা, হীরা ঐশ্বর্যের প্রতীক হলেও এসবে মানুষের পেট ভরে না। ক্ষুধা নিবারণ হয় না। মানুষকে বাঁচবার জন্য খেতে হয়। এজন্য খাদ্য প্রয়োজন। সোনা জীবনে এক রতি না হলেও চলে। কিন্তু খাবার না হলে মোটেও চলে না।

সোনার বিনিময়ে টাকা মেলে। ডলার, পাউন্ড, ইউরো, দিনার ইত্যাদি পাওয়া যায় সোনা দিয়ে। হ্যাঁ, এসব পাওয়া যায়। তবে এই যে বিনিময়, বেচাকেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই কিন্তু উদরপূর্তি বা পেট ভরাবার জন্য। এমনকি, চুরিচামারি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, ব্যাংকের অর্থ চুরি, মেরে দেয়া বা বাইরে পাচার করে দেয়া সবই ভোগবিলাসের লোভে। পেট না থাকলে, ক্ষুধা না লাগলে মানুষ এতো সব করতো না। মানুষকে খেতে হয়, খেয়ে বাঁচতে হয় বলেই এতো ঝুঁকি নিয়ে মানুষ বৈধ অবৈধ বহুবিধ কাজ করে।

সোনা বিনিময় করে টাকা পাওয়া যায়। এ দিয়ে অলঙ্কার প্রস্তুত করে মানুষের বিশেষত নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সোনা খাদ্যবস্তু নয়। সরাসরি এ দিয়ে মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় না। তবে যার অঢেল সোনা থাকে তার মানসিক প্রশান্তি থাকে। আর্থিক নিশ্চয়তা দৃঢ় থাকে। ফলে তার খাদ্যসংকট থাকে না। সোনা দিলেই টাকা পাওয়া যায়। সেটাকায় খাদ্য কেনা যায় খুব সহজে। তবে যার পেটে তীব্র ক্ষুধা বা ক্ষুধার চোটে জীবন বিপন্ন তখন তাকে সোনা দিলে হবে না। সোনাধোয়া পানি খাওয়ালেও ক্ষুধা মিটবে না। এ জন্য খাবার দরকার। ভাত, রুটি, সবজি, লেহ্য-পেয় প্রয়োজন।

কবিতার ভাষায় বলা হয় ‘আমার দেশের মাটি, সোনার চেয়ে খাঁটি।’ কথাটা শুধু কথার কথা নয়। এখানকার মাটি খুবই উর্বর। সামান্য পরিশ্রমে অঢেল ফসল উৎপন্ন হয়। মাটি খুঁড়লেই জীবন পাওয়া যায়। জীবন মানে পানির কথা বলছি। অনেক দেশে পানিও যথেষ্ট দামি। কোনও কোনও দেশে দুধের চেয়ে পানির দাম বেশি। বেশি দূরে নয়, আড়াই দশক আগে হজ মওসুমে মক্কা শরিফ ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম সেখানে দুধ ও পানির দাম সমান। কখনও কখনও দুধের চেয়ে পানির দাম বেশি হয়ে যায়। জ্বালানি তেলের দামতো পানির চেয়ে অনেক দেশেই কম। এখন বুঝুন কী অবস্থা!

যেখানে গ্যাস পাওয়া যায়, তার নিচে তেল থাকা স্বাভাবিক। এটা আমার কল্পনার কথা নয়। বিশেষজ্ঞরাই বলেন। দেশের কয়েক জায়গায় তেল পাওয়ার কথা শোনা গিয়েছিল ৩৫/৪০ বছর আগেই। কিন্তু আজ অবধি সেই তেল আর উঠলো না। উঠবে বলেও মনে হয় না। নানা অজুহাত তুলে তেল চেপে রাখা হলো। তেলের আর কোনও খোঁজ নেই। তেলের নিচে সোনা থাকে। তেলই তুলতে পারি না। সোনাতো আরও নিচে। কাজেই সোনার কথা আমাদের শোনাই সার হলো। এতেই খুশি থেকে ধন্য হলাম আমরা।

সোনা খুব মূল্যবান ধাতু। এর রঙ আকর্ষণীয়। এর প্রতি কোনও নারীর মোহ নেই তা কল্পনাও করা যায় না। সোনার চেয়ে মূল্যবান ধাতু থাকলেও এর প্রতিই সাধারণত সুন্দরীদের আকর্ষণ বেশি। বিশেষত বঙ্গললনারা সোনা ব্যতীত নিজেদের মোহনীয় কোমনীয় করতে যেন অক্ষম। তাই তাদের কাছে সোনাই যেন স্বর্গ। সোনাই যেন সবকিছু।

তবে সোনা দিয়ে ভরে দিলেই সব সংসার সোনার হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। অনেক সংসারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আছে। আছে প্রতিপত্তি। অঢেল সোনাদানা। কিন্তু ভালোবাসা, প্রীতি-সম্প্রীতি নেই। মায়া-মমতার বড্ড অভাব। অর্থাৎ সংসার সোনা হয়নি। প্রকৃত অর্থে সংসার সোনার করে গড়তে হলে যে মানুষগুলোকে সোনা হতে হবে সেদিকে খেয়াল নেই কারুর। মানুষগুলোর মন সোনার হতে হবে। মানুষ যদি সোনা হয়। মানুষের মন-মানসিকতা যদি সোনা হয় তাহলে সোনার খনির দরকার পড়ে না। সোনা দিয়ে এমনিতেই ভরে যাবে দেশ।

যে মানুষ মিথ্যে বলে না, অন্যের ক্ষতি করে না, দেশ ও জাতিকে ভালোবাসে, কথায় ও কাজে যার মিল থাকে, নিজের পরিবার-পরিজন ভালোবাসে, অন্যের গিবত করে না, পরচর্চা থেকে বিরত থাকে, সেইতো সোনার মানুষ। তার মন সোনা। এমন সোনা যেদেশে এবং যেসমাজে জন্মে সেখানে সোনা দিয়ে কী হয়? আমাদের এমন সোনাইতো দরকার। এমন সোনার মানুষ হলে এদেশের ধূলোমাটি সোনা দিয়ে ভরে যেতে পারে অনায়াসে।

একটা ইটের টুকরো অথবা কাঁটা পথের ওপর পড়ে আছে। যেকোনও সময় সেপাথরের টুকরোয় কারুর পায়ে আঘাত লাগতে পারে, কাঁটা পায়ে বিঁধে যেতে পারে। বিপজ্জনক পাথরের টুকরোটি অথবা কাঁটা যেলোক সরিয়ে দিল সেইতো উত্তম মানুষ। সোনার মানুষ। এমন সোনার মানুষের জন্য দেশ এবং সমাজ গর্ব করতে পারে। এমন সোনাই পারে দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে। সমাজকে খাঁটি পথ দেখাতে। এমন সোনার মানুষ হলে সমাজ সুন্দর ও বসবাসযোগ্য করতে কতক্ষণ?
মানুষে মানুষে হিংসা, মারামারি, খুনোখুনি, ফাটাফাটি কেন? সোনার মানুষ হতে পারেনি বলে। মানুষ যদি সত্যই সোনা হতো, মনগুলো যদি সোনা হতে পারতো তাহলে পৃথিবীটাই স্বর্গ হতো। জান্নাত হতো। মানুষ সোনা হয়ে গেলে শুধু নিজের সুখ চিন্তা করে না। অন্যের সুখের কথাও ভাবে। দুঃখের ভাগিদার হয়। এমন যদি সমাজটা হতো তাহলে পৃথিবীতে মানুষ অসুখী কেউ থাকতো না। সবাই সুখী হতে পারতো। কেউ কারুর পেছনে লেগে থাকতো না। সবাই সবার কথা ভাবতো। এমন সোনার মানুষের প্রত্যাশাই করছে পৃথিবী। কবে সে সোনার মানুষ হবো আমরা?

একটা সুন্দর দেশাত্মবোধক গানের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। সেটি হচ্ছে---
“সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা;
সোনা নয় ততো খাঁটি।
বলো যতো খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি
বাংলাদেশের মাটি রে ভাই
আমার বাংলাদেশের মাটি।”

সত্যই বাংলাদেশের মাটির মতো খাঁটি আর কিছু নেই। শুধু এদেশের মানুষ খাঁটি হতে পারছে না। সোনায় পরিণত হতে পারছে না। দেশের মানুষ সোনা হতে পারলে, মানুষের মনগুলো সোনা হলে আমাদের আর ঠেকাতো কে? সোনার মানুষ গড়ে তুলতে যেচেষ্টা ও সাধনার প্রয়োজন তারও কোনও আলামত এখানে দেখা যায় না। তাই সোনার মানুষ আমরা হবো কেমনে? সোনার মনইবা সৃষ্টি হবে কোথা থেকে? দেশের মানুষগুলো খাঁটি সোনা হলে দেশ সোনায় ভরে দিতে কতক্ষণ?

আরেকটা কথা: যাদের হাতে সোনার মানুষ গড়বার দায়িত্ব তাঁরাই চৌর্যবৃত্তির দায়ে ধরা খাচ্ছেন। অন্যের গবেষণার থিসিস মেরে দিয়ে পিএইচ.ডি. হচ্ছেন। এমন "চোরশিক্ষক" কি সোনার মানুষ গড়তে পারবেন কখনও? তবে সবশিক্ষকই চোর নন। সবগুরুই “গরু” নন।

https://dailysangram.com/post/442929